বিনা ভোটেই ৩৪৮ চেয়ারম্যান

বিনা ভোটেই ৩৪৮ চেয়ারম্যান

ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে বিনা ভোটে জয়

প্রথম ধাপ ৭১ জন

দ্বিতীয় ধাপ ৭৭ জন

তৃতীয় ধাপ ১০০ জন

চতুর্থ ধাপ ৪৮ জন

পঞ্চম ধাপ ৫২ জন

২০১৬ সালে ইউপিতে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হন ২০৭ জন। এবার ৫ ধাপেই বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হয়েছেন ৩৪৮ জন।২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হয়েছেন ১১১ জন।চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ৩৪৮ জন বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় এসব ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। এর মধ্যে বেশ কিছু ইউনিয়নে চেয়ারম্যানসহ কোনো পদেই ভোট নিতে হয়নি। সব মিলিয়ে এবার ইউপি নির্বাচনে বিনা ভোটে জনপ্রতিনিধি হওয়ার ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।এবার ছয় ধাপে দেশে প্রায় ৪ হাজার ইউনিয়নে ভোট হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম পাঁচ ধাপে ৩ হাজার ৭৫৫টি ইউনিয়নের ৩৪৮টিতে চেয়ারম্যান পদে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি মানুষ। সে হিসাবে এখন পর্যন্ত ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিনা ভোটে। ষষ্ঠ ধাপে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় এখনো শেষ হয়নি। এই ধাপের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হওয়ার পর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী চেয়ারম্যানের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে একক প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করার ক্ষেত্রে আইনি কোনো বাধা নেই। কিন্তু এভাবে বিপুলসংখ্যক জনপ্রতিনিধি বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। মূলত ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দেশে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো তখন নির্বাচন বর্জন করায় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টিতেই ভোটের প্রয়োজন হয়নি। অর্থাৎ ১৫৩ জন সাংসদ হয়েছিলেন বিনা ভোটে। পরে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও এই ধারা অব্যাহত থাকে। দেশের কিছু এলাকায় বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়া এখন প্রায় রীতিতে পরিণত হচ্ছে। সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যাঁরা বিনা ভোটে জয়ী হচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।


এবার বিনা ভোট নিয়ে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে চট্টগ্রামের রাউজান এবং কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংসদ এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকা রাউজান। এই উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ভোটের তারিখ হলেও ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কোনো সুযোগ পাননি। এসব ইউপিতে শুধু চেয়ারম্যান নয়, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত নারী সদস্য পদের সব কটিতেই প্রার্থী ছিলেন একজন করে। বিনা ভোটে নির্বাচিত এসব চেয়ারম্যান ও সদস্যরা স্থানীয় সাংসদের অনুসারী হিসেবেই পরিচিত। অবশ্য রাউজানে বিনা ভোটের এই চিত্র নতুন কিছু নয়। ২০১৬ সালেও এই উপজেলার ১৪টি ইউপির মধ্যে ১১টিতে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এ ছাড়া ২০১৯ সালে রাউজান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী চেয়ারম্যান পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের নির্বাচনী এলাকা কুমিল্লার লাকসামের মানুষও এবার একই ধরনের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন। এ উপজেলার পাঁচটি ইউপিতে কোনো পদেই ভোটের প্রয়োজন হয়নি। তবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী গত রোববার এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন, তাঁর এলাকায় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে কাউকে চাপ দেওয়া হয়নি। মানুষ মনে করে মন্ত্রীর প্রার্থী হলে একটা সমর্থন পাবে।

রাউজান ও লাকসামের নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনেও সমালোচনা হয়েছিল। গত ১৪ নভেম্বর অনেকটা উপহাস করে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছিলেন, ‘কুমিল্লার লাকসাম ও চট্টগ্রামের রাউজান বিশ্বে আদর্শ নির্বাচনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’ চলমান ইউপি নির্বাচনে বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে মাহবুব তালুকদার সেদিন আরও বলেছিলেন, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, সেখানে নির্বাচন নেই।তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের পাশাপাশি সাধারণ সদস্য পদে ৫৮১ জন এবং সংরক্ষিত সদস্য পদে ২৭৬ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ভোটেও সাধারণ ও সংরক্ষিত সদস্য পদে শতাধিক ব্যক্তি বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।

স্থনীয় সরকার নির্বাচনে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান পদে দলের প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টিকে উৎসাহিত করেন না। তাঁরা চান, যে-ই নির্বাচিত হন, ভোটের মাধ্যমে হন। তবে একজনের বেশি প্রার্থী না থাকলে একক প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করার বিধান বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেই আছে।দশম সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে ইউপি ভোট হয়। ইসি সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ছয় ধাপে মোট ৪ হাজার ১০৪টি ইউপিতে ভোট হয়। এর মধ্যে ২০৭টিতে (৫ দশমিক ০৪ শতাংশ) চেয়ারম্যান হয়েছিলেন বিনা ভোটে। তখন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এবার বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হওয়ার সংখ্যা বেড়ে গেছে। তবে অনেক জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চাপ দিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিনা ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার হিড়িক পড়েছিল। বিএনপি ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল। পাঁচ ধাপে ৪৭০টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ১১১টিতে চেয়ারম্যান পদে ভোট নিতে হয়নি।

ইসি সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবারের ইউপি নির্বাচনে প্রথম ধাপে ৭১ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৭৭ জন, তৃতীয় ধাপে ১০০ জন, চতুর্থ ধাপে ৪৮ জন এবং পঞ্চম ধাপে ৫২ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কেউ নির্বাচনে না দাঁড়ালে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার থাকে না। আইন অনুযায়ী একক প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করতে হয়। সংসদ নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার নজির আছে। তবে যদি কাউকে ভয়–ভীতি দেখিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে চাপ দেয়, সে ধরনের অভিযোগ পেলে ইসি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়, নেবে। তিনি বলেন, বিএনপি দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার এটি একটি কারণ হতে পারে। তবে যারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন, তাঁরা সবাই যে আওয়ামী লীগের, সেটাও নয়। অনেক জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে গত রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে এসে দেখা যায়, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ১১টিতেই ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না। ফেনী জেলায় এবার ভোট হচ্ছে মোট ৪১টি ইউপিতে—এর মধ্যে ২১টিতে চেয়ারম্যান হয়েছেন বিনা ভোটে। বাগেরহাট জেলায় ৭৪টি ইউপির মধ্যে ৪৩টিতে চেয়ারম্যান হয়েছেন বিনা ভোটে। এর আগে ২০১৬ সালের ভোটেও ফেনী ও বাগেরহাটের চিত্র অনেকটা একই রকমের ছিল।সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মানুষ প্রার্থী হচ্ছেন না কেন, এটা দেখতে হবে। বিভিন্ন জায়গায় একাধিক প্রার্থী নেই, তার কারণ বিভিন্নভাবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মাঠছাড়া করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থী হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। আবার স্থানীয় সাংসদ, মন্ত্রীরাও অনেক প্রার্থীকে বসিয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে স্থানীয় সরকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন এই প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবসায়িক লেনদেনের জায়গায় দাঁড় করানো হয়েছে। স্থানীয় সরকারকে কলুষিত করা হয়েছে। এর ফল মঙ্গলজনক হবে না।

By নিজস্ব প্রতিবেদক

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *