বিতর্কিত হচ্ছেন–ঝরেও পড়ছেন আ.লীগের অনেক তরুণ নেতা

বিতর্কিত হচ্ছেন–ঝরেও পড়ছেন আ.লীগের অনেক তরুণ নেতা

টানা ১৩ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া এবং পরে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি এবং স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে তরুণদের জায়গা করে দিয়েছে দলটি। আওয়ামী লীগে তরুণদের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো। কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের রাজনীতিতে উঠে এসেছেন তরুণেরা। তবে নানা কারণে প্রভাবশালী তরুণ নেতারা বিতর্কিতও হচ্ছেন। এতে দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন অনেকে। আবার দল থেকে ঝরেও পড়ছেন কেউ কেউ।বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, বিতর্কিত মন্তব্য, দলের নীতি–আদর্শের পরিপন্থী কাজসহ নানা কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ গাজীপুরের সিটি করপোরেশনের মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম।

এসব নেতার ছিটকে পড়ার ইতিবৃত্ত কী? ব্যক্তিপর্যায়ে নেতৃত্বের স্খলনই কি শুধু এর জন্য দায়ী, না এর জন্য তাঁদের নেতৃত্বের দায় আছে? নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে শাসক দলের কি কোনো দায় নেই? টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ অবস্থা কি এর জন্য দায়ী? এমন নানা প্রশ্ন উঠে আসছে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায়।গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন দেশের সবচেয়ে বড় সিটির সর্বকনিষ্ঠ মেয়র। স্কুলজীবন থেকে রাজনীতি করতেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। হয়েছিলেন গাজীপুর সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। পরে মেয়র। তাঁকে দল বহিষ্কার করেছে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো দলীয় সিটি মেয়রকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনা এই প্রথম।ঢাকার অদূরের রাজনৈতিকভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ শহর গাজীপুরের মেয়রের দল থেকে এই বহিষ্কার দেশের রাজনীতিতে বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জাহাঙ্গীরের মতো তরুণ নেতৃত্বের এভাবে আওয়ামী রাজনীতির মাঠে ছিটকে পড়ার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে আরও কয়েকটি ঘটেছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট ক্যাসিনো–কাণ্ডে এখন কারাগারে আছেন। তিনি ইতিমধ্যে সংগঠন থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। সম্রাট যুবলীগের শ্রেষ্ঠ সংগঠকের সম্মাননাও পেয়েছিলেন।ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ওমর ফারুকসহ অনেক প্রভাবশালী নেতাই এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। অবশ্য সবাই বহিষ্কৃত হয়েছেন, এমনটা নয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ কে এম মাহমুদুল হক মনে করেন, নতুন নেতৃত্বের বিতর্কিত হয়ে ছিটকে পড়ার কারণটি নৈতিকতার অভাব। এ নৈতিকতার স্খলনের দায়ভার এসব ব্যক্তির ওপর যেমন বর্তায়, তেমনি এর দায় তাঁদের নিয়ন্ত্রণকারীরা এড়াতে পারেন না। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায়। এ সময়ে হওয়া একাধিক নির্বাচনে নিয়ে বিতর্ক আছে। আছে সুশাসনের ঘাটতিও। এই সুশাসনের ঘাটতিকে নেতৃত্বের বিপথগামী হয়ে যাওয়ার একটি কারণ বলে মনে করেন মাহমুদুল হক। তিনি বলেন, ‘অনেকেই জনগণকে ম্যানেজ করে দলের মনোনয়ন পেতে আগ্রহী নন। হয়তো দরকারও হয় না। তাঁরা তাঁদেরই ম্যানেজ করে, যাঁরা ক্ষমতাশালী। তাঁদের সাধারণের জন্য দায়িত্ব থাকে না। আর এই না থাকার কারণে দায়িত্বহীনতা, ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা বাড়তে থাকে।’


চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠায় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নিজে এই দুই নেতাকে সংগঠনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনে রেজওয়ানুল হক চৌধুরীকে সভাপতি এবং গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক হন। এ কমিটির মেয়াদ ছিল দুই বছর। ২০১৯ সালের শুরুতে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলও হয়েছিল শোভন-রাব্বানীর নেতৃত্বে। রাব্বানী জিএস পদে জিতলেও হেরেছিলেন ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল। পরে রেজওয়ানুল ও রাব্বানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ থেকে চাঁদা দাবি করেন বলে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম অভিযোগ তোলার পর ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় শোভন ও রাব্বানীকে।

ছাত্রলীগের সাবেক কয়েক নেতা ছাত্রলীগের কমিটি করে দেন—এমন আলোচনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেজওয়ানুল ও রাব্বানীকে দায়িত্ব দেন। চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে দুই নেতাই পদ হারান। তা ছাড়া টাকার বিনিময়ে ও নিজেদের লোক দিয়ে বারবার কমিটি গঠনের পেছনে থাকা সাবেক কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাও বিতর্কিত হন। আওয়ামী লীগে পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে এসব নেতার এই অভিযোগগুলো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। আওয়ামী লীগের সাংসদ ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবালুর রহিম বলেন, যেসব তরুণ নেতা বিপথগামী হয়েছেন, তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিত ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। তবে এসব নেতৃত্বের ভুল পথে যাওয়াটা ‌‌‌‌‌‌‘অর্থনীতির অনৈতিক প্রতিযোগিতার ফসল’ বলে মনে করেন তিনি। তাঁর কথা, যেসব নেতা এসব পথে গেছেন, তাঁরা সাজা পেয়েছেন। দলীয় নেতৃত্বের কঠোর অবস্থানের জন্য এটা হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করা ইকবালুর রহিম মনে করেন, তরুণ নেতৃত্বের এই নাজুক অবস্থা দলের জন্য কিছুটা ক্ষতিকর তো বটেই। তবে তিনি এ–ও বলেন, ‌‘সব কুঁড়িই ফুল হয়ে ফোটে না। কিছু কুঁড়িতেই ঝরে যায়।’

ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনকে ক্ষমতার এক মেয়াদের পরই বিদায় নিতে হয়েছে। দল তাঁকে আর মনোনয়ন দেয়নি। ক্ষমতা হারিয়ে সাঈদ খোকন বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছেন বিস্তর। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন সাঈদ খোকন। তাঁর বাবা মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটির প্রথম নির্বাচিত মেয়র। ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, দলীয় কোন্দলে যুক্ত হওয়া, সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ—সব মিলিয়ে মনোনয়ন পাননি তিনি। মেয়র পদে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শুরু থেকেই নানা বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দেন সাঈদ খোকন। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর আজিমপুরের পার্ল হারবাল কমিউনিটি সেন্টারসংলগ্ন আওয়ামী লীগের কর্মী সমাবেশের পাশে পাল্টা কর্মসূচি দেন সাঈদ খোকন। এমনকি আওয়ামী লীগের ওই সমাবেশের সামনে ট্রাকে করে সিটি করপোরেশনের ময়লা ফেলার ঘটনায় তাঁকেই দোষারোপ করা হয়। ওই সময় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ ও মেয়র খোকনের মধ্যে দ্বন্দ্ব দলীয়ভাবে ব্যাপক সমালোচিত হন।


সাঈদ খোকন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদে থাকলেও ঢাকার রাজনীতিতে এই নেতা প্রভাব ও গুরুত্ব—দুটিই হারিয়েছেন।২০১০ সালে ভোলার লালমোহন আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তরুণ নেতা নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। ঢাকায় ছাত্রলীগের রাজনীতির মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি এই নেতার। যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতাও ছিলেন। কিন্তু ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর এই নেতাকে তেমন সরব আর দেখা যায়নি। তরুণ ও সম্ভাবনাময় নেতৃত্বের রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়া, বিতর্কিত হওয়া নিয়ে চিন্তিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও। সত্তর দশকের ডাকসুর নেতা এবং পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘দলের সদস্য সংগ্রহে প্যারামিটার ঠিক কতে হবে। এর অভাব আছে। সরল অঙ্ক করতে গিয়ে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বন্ধনী মুক্ত করতে হয়। রাজনীতিতেও এই অঙ্কের ব্যবহার করতে হবে।

নেতা নির্বাচন করতে হলে পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। এর জন্য চাই প্রয়োজনীয় মানদণ্ড নির্ধারণ। এখন যেভাবে নেতা নির্বাচন করা হয়, সেই ব্যবস্থার পুরো পর্যালোচনা দরকার।’ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, নতুন নেতৃত্বের অনেকেই এমন কাজ করেন যে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। তাঁর মতে, এভাবে নেতৃত্বের স্খলন দলীয় রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর। এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসন কি দলের মধ্যে এসব অপরাজনীতির চর্চা তৈরিতে সহায়তা করছে কোনোভাবে—এই প্রশ্নের কোনো জবাব অবশ্য দিতে চাননি পীযূষ কান্তি।

By নিজস্ব প্রতিবেদক

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *