দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ‘ইমেরিটাস পাবলিশার’ পদবিপ্রাপ্ত প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদ আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ৫৯ মিনিটে রাজধানীর একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
রাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি জানান মরহুমের মেয়ে ও ইউপিএলের পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন।
মঙ্গলবার সকালে মাহরুখ দেশ রূপান্তরকে বলেন, “বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন বাবা। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে তিনি কিছুদিন ধরেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।”
আরও জানান, মঙ্গলবার গুলশান আজাদ মসজিদে যোহরের নামাজের পর মহিউদ্দিন আহমেদের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
গত দুই দশক ধরে পারকিনসন রোগের সঙ্গে লড়ছিলেন বাংলা প্রকাশনা জগতের অবিস্মরণীয় এ ব্যক্তিত্ব। কিছুদিন আগে তিনি কভিডে আক্রান্ত হন ও সেরে উঠেন।
মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ১৯৮১ সাল থেকে মোট ১৬ বার ইউপিএল ‘ন্যাশনাল বুক সেন্টার’ পুরস্কার লাভ করে। ১৯৯১ সালে তিনি স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। পরিবেশের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ১৭ জন প্রকাশককে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান। মহিউদ্দিন ছিলেন তাদের মধ্যে একজন।
২০১৪ সালে ‘বাংলাদেশ অ্যাকাডেমিক অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন’ কর্তৃক প্রদত্ত ‘ইমেরিটাস পাবলিশার’ পদবি লাভ করেন তিনি।
অ্যারিজোনার বেনসনে অবস্থিত ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি’র আন্তর্জাতিক কার্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে তাকে ‘পাবলিশিং ম্যানেজমেন্ট’ (প্রকাশনা ব্যবস্থাপনা) বিষয়ে ‘কালচারাল ডক্টোরেট’ ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
১৯৪৪ সালে ফেনীর পরশুরামে মহিউদ্দিন আহমেদের জন্ম। তার বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পোস্টাল সার্ভিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। নটর ডেম কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ‘ব্লু অ্যান্ড গোল্ড’ নামক কলেজ ম্যাগাজিনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মহিউদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় পড়া শেষ করে পাকিস্তান কাউন্সিল স্কলারশিপ নিয়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। সে সময় তিনি পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ক্রনিকলের সম্পাদক ছিলেন।
এমএ পড়া শেষে তিনি পাকিস্তান টাইমসে শিক্ষানবিশ সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। চাকরিতে যোগদানের প্রথম দুই মাসের মধ্যেই পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে ‘মাস কমিউনিকেশন ও পাবলিক রিলেশন্স’ বিষয়ের সহকারি প্রভাষক হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব পান।
১৯৬৯ সালে মহিউদ্দিন আহমেদ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি-র জন্য আবেদন করেন এবং উঁচু নের আর্থিক সহায়তা তথা বৃত্তি সহকারে তা গৃহীত হয়। একই সময়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (ওইউপি)-এর পাকিস্তান শাখায় সম্পাদক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সেখানেও আবেদন করেন।
পরে ওইউপি পাকিস্তান শাখার সম্পাদক হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে দুই বছর ওইউপি ঢাকা শাখার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৭৫ সালে ওইউপি-এর ঢাকার কার্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে মহিউদ্দিন আহমেদকে করাচি শাখায় ‘এডিটর-অ্যাট-লার্জ’ বা রোভিং এডিটর হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু করাচীতে একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বাস করার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। আর এই সিদ্ধান্তই তাকে ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড’ নামে নিজের প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করার প্রেরণা ও সুযোগ এনে দেয়। ইউপিএল প্রধানত পাঠ্যবই ও রেফারেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় বই প্রকাশ করে থাকে।
বাংলাদেশি লেখক ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত লেখক ও শিক্ষাবিদদের রচিত বিভিন্ন বই তিনি প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশে প্রকাশিত বই যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করার মাধ্যমে এই দুই দেশের মধ্যে সে সময় পর্যন্ত বিদ্যমান একমুখী এই ব্যবসায়কে তিনি বিপরীত দিকে চালনা করতে শুরু করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানিকৃত পাঠ্যবইয়ের একটি বড় অংশ প্রকাশ হয় ইউপিএল থেকে।
১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে, দেশের ইতিহাস সঠিক ও পর্যাপ্তরূপে সংরক্ষণের অভাব অনুধাবন করে ‘রোড টু বাংলাদেশ’ নামে একটি ধারাবাহিক প্রকাশনার সূচনা করেন মহিউদ্দিন। এই ধারাবাহিকের অধীনে প্রকাশিত বইয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের স্বাধীনতায় ভূমিকা পালনকারী অন্যান্য ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।
২০১২ সালে মহিউদ্দিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশ করেন। ১৯৬৬-৬৯ সময়কালে কারাগারে বন্দীদশায় বঙ্গবন্ধু দিনলিপি আকারে এই আত্মজীবনী লিখেছিলেন। বাংলা ভাষার পাশাপাশি বইটি একইসঙ্গে ভারত (পেঙ্গুইন) ও পাকিস্তানে (ওইউপি) ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় প্রকাশ করার ব্যবস্থাও তিনি করেন।
এ ছাড়া ‘রিপোর্ট অব দ্য টাস্কফোর্সেস অন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস ফর দ্য ১৯৯০’ ইউপিএলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা। মহিউদ্দিনের ভাষ্য অনুযায়ী, এরশাদ সরকারের পতনের পরপরই ২৯টি টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটি চিত্র হিসেবে তৈরি করা হয়।
মহিউদ্দিন আহমেদ রচিত বইয়ের সংখ্যা দুই। সমকালীন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধের সংকলন সম্পাদনা করেছেন তিনি। এ ছাড়া দেশে ও বিদেশে পুস্তক প্রকাশনা বিষয়ে প্রকাশ হয়েছে লেখা। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় উন্নয়ন বিষয়েও তার রচিত নিবন্ধ এক সময় নিয়মিত প্রকাশ হতো।