প্রায় আড়াই বছর আগে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। প্রবৃদ্ধি আট অঙ্কের ঘরে পৌঁছানোয় তখন অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকেরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ, যা গত চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু তিন বছর পর জিডিপি গণনার ভিত্তি বছর পরিবর্তন করায় সেই আট অঙ্কের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। নতুন হিসাবে ওই বছরের প্রবৃদ্ধি এখন দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশে। ফলে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়টি ‘অর্থহীন’ হয়ে গেছে।জিডিপির নতুন ভিত্তি বছর ধরা হয়েছে ২০১৫-১৬। তাতে গত চার অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। তবে প্রবৃদ্ধি কমলেও বেড়েছে জিডিপির আকার। আর তাতেই মাথাপিছু আয় আগের চেয়ে বেড়েছে। বিবিএসের জাতীয় আয় শাখার এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, নতুন ভিত্তি বছর ধরে জিডিপির হিসাবটি এখন চূড়ান্ত হিসাবেই ধরা হবে।প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ২০২০ সালের ১৩ জুন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘এক দশক ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যা এশিয়ার সব দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমাদের প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি ছিল শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, জিডিপির ভিত্তি বছর বদলানোয় হিসাব বদলেছে, বাস্তবতা বদলায়নি। নতুন ভিত্তি বছরের মাধ্যমে জিডিপি গণনায় নতুন নতুন খাত যুক্ত হয়েছে। ফলে জিডিপির আকার ১৫-১৬ শতাংশ বেড়েছে। এতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে। তিনি আরও বলেন, জিডিপির আকার বেড়ে যাওয়ায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে। তবে আগে একজন রিকশাওয়ালা যা আয় করতেন, এখনো তা–ই আয় করেন।পুরো বিষয়টি ইতিবাচক নাকি শুভংকরের ফাঁকি, তা বুঝতে হলে বিবিএসের ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, নতুন ভিত্তি বছরের জিডিপির হিসাবটি আরও পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করা উচিত। কিন্তু বিবিএসের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাখ্যা মেলেনি।
চার বছরই প্রবৃদ্ধি কমেছে
দুটি ভিত্তি বছরের হিসাব মিলিয়ে দেখা গেছে, গত চার অর্থবছরেরই প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে কমে গেছে। ২০০৫-০৬ ভিত্তি বছরের হিসাবে, ২০২০-২১ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। নতুন হিসাবে তা ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি কমে ৭ শতাংশের ঘরে নেমেছে। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮৬ থেকে কমে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ হয়েছে।আবার চলতি মূল্যে জিডিপির আকার বেড়েছে প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। নতুন হিসাবে গত অর্থবছর শেষে জিডিপির আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ কোটি টাকা। জিডিপির আকার বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। কারণ, দেশের সামগ্রিক আয় বাড়লেও জনসংখ্যা বাড়েনি। তাই মাথাপিছু আয় একলাফে বেড়ে গেছে। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে মাথাপিছু আয় ৩২৭ মার্কিন ডলার বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার হয়ে গেছে, আগের হিসাবে যা ছিল ২ হাজার ২২৭ ডলার। এভাবে আগের তিন বছরেও প্রতিবার মাথাপিছু আয় গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ ডলার বেড়েছে।এখানে উল্লেখ্য, মাথাপিছু আয় কোনো ব্যক্তির আয় নয়। এটি একটি দেশের অভ্যন্তরে এবং দেশের বাইরে থেকে আসা প্রবাসী আয়সহ অন্যান্য আয়কে যোগ করার পর জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয় বের করা হয়।
বিনিয়োগ বেশি, উৎপাদনশীলতা কম
জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিনিয়োগের একটি সম্পর্ক আছে। মোটাদাগে, কম বিনিয়োগ করে উৎপাদন বেশি হলে সেটিকে উচ্চ উৎপাদনশীলতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নতুন ও পুরোনো দুই ভিত্তি বছরের হিসাবেই তিন বছর ধরে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে। তবে আগে যত টাকা বিনিয়োগ করে যত পণ্য বা সেবা সৃষ্টি করা যেত, এখন সেই গতিতে পণ্য বা সেবা সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। কোভিডের কারণে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় এটি আরও প্রকট হয়েছে।ক্রমবর্ধমান মূলধন উৎপাদন অনুপাত (আইসিওআর) ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৬৬; ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯ দশমিক ০৫; ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪ দশমিক ০৮। আইসিওআর যত বেশি, উৎপাদনশীলতা তত কম। এর মানে, পণ্য উৎপাদন বা সেবা সৃষ্টি করতে উদ্যোক্তাদের আগের চেয়ে বেশি টাকা লগ্নি করতে হচ্ছে।এ বিষয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, নতুন হিসাবে বিনিয়োগের যে চিত্র পাওয়া গেছে, তাতে বিনিয়োগের হিসাব বদলেছে ঠিকই কিন্তু বিনিয়োগ পরিবেশের বাস্তবতা বদলায়নি।