দেশে মূল্যস্ফীতির হিসাব কতটা সঠিক

দেশে মূল্যস্ফীতির হিসাব কতটা সঠিক

সরকারি হিসাবে এখন দেশের মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশ। এটি ১২ মাসের চলমান গড়ের ভিত্তিতে। আর পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে তা এখন ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সর্বশেষ উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে সেপ্টেম্বরের। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও হালনাগাদ তথ্য বা উপাত্ত সরকার দিতে পারছে না। তবে সর্বশেষ উপাত্ত ঠিক থাকলে দেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন নিঃসন্দেহে সহনীয় মাত্রায় আছে।
সাধারণত বলা হয়ে থাকে ১০ শতাংশ না ছাড়ালে মূল্যস্ফীতি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে অনেকে মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশের মধ্যে রাখার কথাই বেশি বলেন। আর অর্থনীতিবিদেরা তো মনেই করেন সহনীয় মাত্রায় কিছুটা মূল্যস্ফীতি থাকা অর্থনীতির জন্য ভালো। কারণ, এতে উৎপাদন বাড়ে, উৎপাদকেরা উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহী হন।

তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা :
মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় অর্থনীতির নীরব ঘাতক। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষকে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়, সেই অর্থকে বলা হয় একধরনের বাধ্যতামূলক কর। এতে ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের। হিসাবটা পরিষ্কার। আগে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা ব্যয় করতে হতো, মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ হলে সেই একই পণ্য কিনতে হবে ১১০ টাকায়। কিন্তু ওই বাড়তি ১০ টাকা আয় না বাড়লে কী হবে? ১০ টাকার পণ্য কম কিনতে হবে। মূল্যস্ফীতিতে এমনটাই ঘটে। প্রকৃত আয় কমে, ভোগও কমে যায়।


সুতরাং দেশে যদি সাড়ে ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি থাকে, তাহলে তো দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু সমস্যা এখানেই। পরিকল্পনামন্ত্রী কদিন আগে বললেন যে রাত পোহালেই নিজের অজান্তে দেশের মানুষ বড়লোক হয়ে যাচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে বড়লোক হলে তা নিজেরই টের পেতে হয়, দূরে বসে কেবল পরিকল্পনামন্ত্রী বা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) টের পেলেই হবে না। মূল্যস্ফীতি বিষয়টিও তাই। সরকারি হিসেবে যা–ই থাকুক, দেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু ঠিকই টের পাচ্ছে মূল্যস্ফীতির চাপ। বাজারে প্রায় সব পণ্যের দরই ঊর্ধ্বমুখী। ব্যয় বেড়েছে সাধারণ মানুষের। বাজার অসহনীয়, কিন্তু সরকারি কাগজে মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় মাত্রায়। তাহলে মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দেওয়া হয়, তা কি সঠিক? সাড়ে ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির হিসাব আসলে কতটা নির্ভরযোগ্য।

সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে ২৩ শতাংশ। আর পরিবহন ভাড়া বেড়েছে ২৭ শতাংশ। এটা তো গত কয়েক দিনের তথ্য। কিন্তু সরকারি আরেক সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানাচ্ছে, চলতি নভেম্বর মাসেই চালের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশ, ময়দার দাম বেড়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ, খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ, আলুর বেড়েছে ৪১ দশমিক ২ শতাংশ, রুই মাছের বেড়েছে ২০ শতাংশ, মুরগির (ব্রয়লার) ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ, চিনির বেড়েছে ২৪ শতাংশ আর ডিমের দর বেড়েছে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এসব পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছে, বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সরকারের হিসাব মিলছে না। ফলে দেশের মূল্যস্ফীতির উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অবশ্য কেবল মূল্যস্ফীতিই নয়, সামগ্রিকভাবেই দেশের পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নতুন কিছু নয়। তবে ইদানীং এ প্রশ্ন বাড়ছে।

চাপে সাধারণ মানুষ :
ছোটগল্পের জন্যই বিখ্যাত বনফুল। বনফুল ১৯৭৭-এ রোজনামচায় লিখেছিলেন, ‘শাসকেরা পাকে-প্রকারে বলেছেন—বারো টাকা কেজির তেল দিয়ে ভাল করে ভাজ/চোদ্দ টাকা কেজির মাছ/তারপর আমাদের জয়ধ্বনি দিয়ে দু’হাত তুলে নাচ।’ বর্তমান সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন, মনে হবে এ সময়কারই কথা। পার্থক্য হচ্ছে এর দাম-দর। ১২ টাকা কেজির তেল বা ১৪ টাকা কেজির মাছটা একটু বদলে দিলেই হবে। তবে শাসকদের জয়ধ্বনি তুলে নাচটা কিন্তু দিতেই হবে। বিশেষ করে একলাফে জ্বালানি তেলের দর লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর পরে যেভাবে সরকারের মন্ত্রীরা এর পক্ষে সাফাই গাইছেন, তাতে জয়ধ্বনি করা ছাড়া উপায় কী।

সন্দেহ নেই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে মানুষের জীবনযাত্রায়। এমনিতেই সারা বিশ্ব এখন মূল্যস্ফীতির আতঙ্কে আছে। কোভিডকালে সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। কমেছে উৎপাদন। আর বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ সংক্রমণ কমে যাওয়ার কারণে অর্থনীতিও পুনরুদ্ধারের পথে। এ সুযোগে এখন তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো আগের লোকসান তুলে নিতে তেল উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণেই বাড়ছে জ্বালানি তেলের দাম। িএ পরিস্থিতিতে সব সরকারই উভয়সংকটে। কেননা, দেশের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ব্যাহত হবে। আর না বাড়ালে বাড়বে সরকারের লোকসান। পাশের দেশ ভারত শেষ পর্যন্ত কর কমিয়ে সরকার লোকসানের ভাগ নিজের কাঁধে নিয়ে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে। আর বাংলাদেশ কঠিন এক সময়ে একবারেই সর্বোচ্চ হারের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়ে সব চাপ সাধারণ মানুষের ওপরে ফেলে দিয়েছে।

কার কী ভূমিকা :
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বা জ্বালানি মন্ত্রণালয় চাইবেই তেলের দাম বাড়ানো হোক। কারণ বিপিসির লোকসান হচ্ছিল। কিন্তু সরকার ভাববে সামগ্রিক দিকটি। তারা পর্যালোচনা করবে এর প্রভাব ও বিকল্প নিয়ে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মূলত কাজ করে সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুতরাং এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও একটি ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। এমনিতেই এখন আর মন্ত্রী ও আমলারা ছাড়া সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার কেউ নেই। অনেক দেশে অর্থনীতি বিষয়ে পরামর্শ দিতে নানা ধরনের উপদেষ্টা কমিটি থাকে। বাংলাদেশেও একসময় ছিল। এখন আর নেই। ফলে সরকার একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, তারপর এ নিয়ে সমালোচনা হলে দল বেঁধে সাফাই গাইতে শুরু করে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে এখন যা হচ্ছে।

By নিজস্ব প্রতিবেদক

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *