দৃষ্টি হিফাজতে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ১০ উপকারিতা

দৃষ্টি হিফাজতে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ১০ উপকারিতা, বর্তমানে যুবসমাজ ধ্বংসের সবচেয়ে বড় উপাদান বা কারণ হল দৃষ্টিশক্তির লাগামছাড়া ব্যবহার। বিশিষ্ট ইসলামি আলিম ইবনুল কাইয়িম রাঃ তার নানা গ্রন্থে ও রচনায় নজর হিফাজতের বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। তিনি সেখানে নজর হিফাজতের নানা উপকারিতা নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছেন। এখানে নজর হিফাজতের দশটি উপকারিতা উল্লেখ করা হলঃ

নিজের পবিত্রতা রক্ষা করা

দৃষ্টি অবনমিত রাখার দ্বারা নিজের পবিত্রতা রক্ষা করা যায় এবং কুচিন্তা থেকে নিজেকে বাঁচানো সহজ হয়। কু-জায়গা থেকে নিজেদের দৃষ্টিকে বিরত রাখার দ্বারা ব্যক্তিরা পারস্পরিক মেলামেশা ও চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে পবিত্রতা বজায় রাখতে পারে।

قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ اَبۡصَارِهِمۡ وَ یَحۡفَظُوۡا فُرُوۡجَهُمۡ ؕ ذٰلِکَ اَزۡکٰی لَهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا یَصۡنَعُوۡنَ ﴿۳۰﴾  وَ قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِهِنَّ وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَهُنَّ 

মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। আর মুমিন নারীদেরকে বল, যেন তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। [সুরা নুরঃ ৩০-৩১]।

জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ বাজালিথেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“ইচ্ছা ছাড়াই হঠাৎ কোন বেগানা নারীর উপর দৃষ্টি পতিত হলে সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নাও। [মুসলিমঃ ২১৫৯] 

আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিসে আছে, 

‘প্রথম দৃষ্টি মাফ এবং দ্বিতীয় দৃষ্টিপাত গোনাহ।’ [আবু দাউদঃ ২১৪৯, তিরমিযীঃ ২৭৭৭, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩৫১, ৩৫৭] 

এর উদ্দেশ্য এই যে, প্রথম দৃষ্টিপাত অকস্মাৎ ও অনিচ্ছাকৃত হওয়ার কারণে ক্ষমার্হ। নতুবা ইচ্ছাকৃতভাবে প্রথম দৃষ্টিপাতও ক্ষমার্হ নয়। দৃষ্টি হিফাজতে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ১০ উপকারিতা । হাদীসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“আল্লাহ্ তা’আলা বনি আদমের উপর কিছু কিছু ব্যভিচার (জিনা) হবে জানিয়ে দিয়েছেন, তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। চক্ষুর জিনা হল তাকানো, …। [বুখারীঃ ৬২৪৩, ৬৬১২, মুসলিমঃ ২৬৫৭]

একটি হাদিসে নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“নিজের স্ত্রী ও ক্রীতদাসী ছাড়া বাকি সবার থেকে নিজের সতরের হেফাজত করো।” 

এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করে, আর যখন আমরা একাকী থাকি? 

জবাব দেনঃ “এ অবস্থায় আল্লাহ থেকে লজ্জা করা উচিত, তিনিই এর হকদার।” [আবু দাউদঃ ৪০১৭, তিরমিযীঃ ২৭৬৯, ইবনে মাজহঃ ১৯২০]। 

দৃষ্টি হিফাজতে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ১০ উপকারিতা

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“কোন লোক যেন অপর লোকের লজ্জাস্থানের দিকে না তাকায়, অনুরূপভাবে কোন মহিলা যেন অপর মহিলার লজ্জাস্থানের দিকে না তাকায় এবং কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষের সাথে একই কাপড়ে অবস্থান না করে, তদ্রুপ কোন মহিলাও যেন অপর মহিলার সাথে একই কাপড়ে অবস্থান না করে। [মুসলিমঃ ৩৩৮]

ইমান শক্তিশালী করে

ইবনুল কাইয়িম জোর দিয়ে বলেন যে, দৃষ্টি নত করা একজন ব্যক্তির ইমানকে শক্তিশালী করার জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। এটি আল্লাহর আদেশের প্রতি আনুগত্যের এক নিদর্শন। দৃষ্টি হিফাজতে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ১০ উপকারিতা, পাশাপাশি এটি নৈতিক মূল্যবোধ বজায় রাখার জন্য ব্যক্তির আন্তরিক প্রতিশ্রুতির বহিঃপ্রকাশ।

اَلَّذِیۡنَ یَجۡتَنِبُوۡنَ کَبٰٓئِرَ الۡاِثۡمِ وَ الۡفَوَاحِشَ اِلَّا اللَّمَمَ ؕ اِنَّ رَبَّکَ وَاسِعُ الۡمَغۡفِرَۃِ ؕ هُوَ اَعۡلَمُ بِکُمۡ اِذۡ اَنۡشَاَکُمۡ مِّنَ الۡاَرۡضِ وَ اِذۡ اَنۡتُمۡ اَجِنَّۃٌ فِیۡ بُطُوۡنِ اُمَّهٰتِکُمۡ ۚ فَلَا تُزَکُّوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ ؕ هُوَ اَعۡلَمُ بِمَنِ اتَّقٰی ﴿۳۲﴾ 

যারা ছোট খাট দোষ-ত্রুটি ছাড়া বড় বড় পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে, নিশ্চয় তোমার রব ক্ষমার ব্যাপারে উদার, তিনি তোমাদের ব্যাপারে সম্যক অবগত। যখন তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যখন তোমরা তোমাদের মাতৃগর্ভে ভ্রূণরূপে ছিলে। কাজেই তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। কে তাকওয়া অবলম্বন করেছে, সে সম্পর্কে তিনিই সম্যক অবগত। [সুরা নাজম : ৩২]

ইবাদতে একাগ্রতা বাড়ায়

যখন কেউ তার দৃষ্টি নিচু রাখার অভ্যাস চর্চা করে, তখন তারা তাদের ইবাদতমূলক কাজগুলো যেমন সালাত আদায় এবং কুরআন তিলাওয়াতের মতো কাজগুলো আরও ভালভাবে মনোযোগের সাথে করতে পারে। দৃষ্টি হিফাজতে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ১০ উপকারিতা, এটি স্রষ্টার সাথে ব্যক্তির গভীর সংযোগ গড়ে তোলে এবং আধ্যাত্মিকতার গুণগতমানকে উন্নত করে।

নম্রতা এবং বিনয় সৃষ্টি

দৃষ্টিকে অবনমিত রাখার দ্বারা ব্যক্তির নম্রতা ও বিনয় বাড়ে। তারা নিজেদের প্রতি অযথা মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে না। অযাচিতভাবে মানুষের থেকে সম্মান পেতে চায় না। নজর হিফাজতের দ্বারা বাহ্যিকতার বদলে বরং অন্তরের গুণই বেশি গুরত্ব পায়।

قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ اَبۡصَارِهِمۡ وَ یَحۡفَظُوۡا فُرُوۡجَهُمۡ ؕ ذٰلِکَ اَزۡکٰی لَهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا یَصۡنَعُوۡنَ ﴿۳۰﴾ 

মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। [সুরা নুরঃ ৩০]

দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলে 

নজরের হিফাজতকারী ব্যক্তিরা অন্যদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। এতে পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সহানুভূতি বাড়ে। এর দ্বারা ব্যক্তি নিজের আত্মোন্নয়নে আরো অগ্রসর হয়। 

পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষা করে

দৃষ্টি হিফাজত করা ব্যক্তিদের অবৈধ সম্পর্ক এবং পরকিয়া থেকে রক্ষা করে, বিয়ে ও পারিবারিক জীবনের পবিত্রতা রক্ষা করে।দৃষ্টি হিফাজতে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ১০ উপকারিতা,  নজর হিফাজত বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের প্রতীক। এর দ্বারা সামাজিক সম্প্রীতি বজায় থাকে।

وَ لَا تَقۡرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّهٗ کَانَ فَاحِشَۃً ؕ وَ سَآءَ سَبِیۡلًا ﴿۳۲﴾ 

আর তোমরা ব্যভিচারের কাছে যেয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ। [সুরা ইসরাঃ ৩২]

মানসিক ও আবেগিক সুস্থতা রক্ষা করে

ক্রমাগত বদ জায়গায় নজর দেওয়া, নিজের ভেতর কুরুচিপুর্ণ জিনিস দেখার আকাঙ্খা ও অভ্যাস থাকা ব্যক্তির মানসিক সুস্থতার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। নজর হিফাজতকারী ব্যক্তিরা নানা ট্রিগার এড়িয়ে যেতে পারে।দৃষ্টি হিফাজতে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ১০ উপকারিতা,  আর এই কাজে ব্যর্থ হলে নিজের মধ্যে জন্ম নেয় ঈর্ষা, অন্যের সাথে নিজের তুলনা, অসন্তুষ্টি এবং অন্যান্য ক্ষতিকর আবেগ।

শয়তানকে হৃদয়ে প্রবেশ করতে বাধাগ্রস্ত করে

নজর হিফাজতকারীর দেহে শয়তান সহজে প্রবেশ করতে পারে না। বর্ণিত আছে যে, দৃষ্টি হল শয়তানের বিষাক্ত একটি তির। শয়তান যখন কোনো ব্যক্তিকে সহজে কাবু করতে পারে না তখন সে ব্যক্তিকে দৃষ্টির খেয়ানত করিয়ে নেয়। এটি এমন এক পাপ যা সরাসরি হৃদয়কে কলুষিত করে দেয়। হৃদয়ে মরিচা পড়ে যেতে যেতে এক পর্যায়ে সেটা পুরোপুরি পাপের কালো অন্ধকারে ছেয়ে যায়। কিন্তু যে নজর হিফাজত করে তার অন্তরের ওপর দখল শয়তান এত সহজে নিতে পারে না।

মানসিক শান্তি ও প্রশান্তি অর্জন

নজর হিফাজত ও চিন্তার পবিত্রতা অর্জনের দ্বারা একজন ব্যক্তি নিজের ভেতর মানসিক শান্তি ও প্রশান্তি অনুভব করতে পারে। ফলে তারা আল্লাহর জিকিরের ফিকিরে সর্বদা নিজেদের ডুবিয়ে রাখতে পারে এবং আল্লাহর ইবাদত করার দ্বারা নিজের অন্তরকে পরিতৃপ্ত রাখতে পারে।

اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَطۡمَئِنُّ قُلُوۡبُهُمۡ بِذِکۡرِ اللّٰهِ ؕ اَلَا بِذِکۡرِ اللّٰهِ تَطۡمَئِنُّ الۡقُلُوۡبُ ﴿ؕ۲۸﴾ 

‘যারা ইমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়’। [সুরা রাদঃ ২৮]

নৈতিকতা বৃদ্ধি

নজর হিফাজতকারী ব্যক্তিরা প্রবল নৈতিক নীতিসম্পন্ন। তারা ব্যক্তিগতভাবে সর্বদা সততা বজিয়ে রাখার প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।দৃষ্টি হিফাজতে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ১০ উপকারিতা,  এর দ্বারা ব্যক্তির নিজের চাহিদা ও কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ক্ষমতা বোঝায়। ফলে এগুলো অনসরণের দ্বারা ব্যক্তির চারিত্রিক ও নৈতিক বৈশিষ্ট্য উন্নততর হয়।

মননশীলতা বিকাশ করা

নজর হিফাজতকারী ব্যক্তিরা আরও সচেতন এবং বর্তমানে উপস্থিত থাকে। ফলে তারা প্রাকৃতিক বিশ্ব এবং মানুষের মিথস্ক্রিয়াগুলোর সূক্ষ্মতা ভালোমতো বুঝতে পারে। তাদের চারপাশের সৌন্দর্যের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে তারা।

 

সুতরাং প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীকে অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দৃষ্টি হিফাজতে তৎপর হতে হবে। দৃষ্টি হিফাজতে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক ১০ উপকারিতা , এতে যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক ও জাগতিকভাবেও নিজেকে সমৃদ্ধ হিসেবে গড়ে তোলা যাবে।

 

Leave a Comment