দুই টুকরো গরুর মাংস

গরুর মাংস দেখলেই আয়ান চৌধুরীর চোখে পানি চলে আসে। তিনি এই জিনিস মুখে তুলতেই পারেন না। তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানরা মনে করে, তিনি গরুর মাংস পছন্দই করেন না।

কিন্তু তাদের মনে করাটা সত্য নয়। গরুর মাংস তাঁর অত্যধিক পছন্দের। এই কথা শুধু তিনিই জানেন, আর কাউকে জানানো হয়নি। তাঁর বাসায় প্রত্যেক বেলা খাবারের সাথেই এই তরকারি থাকে। মাঝেসাঝে খেতে মন চাইলেও তাঁর গলার ভিতর যেন মস্ত একটা খিল আটকে যায়, মস্তিষ্কে সাজিয়ে রাখা অতীত স্মৃতির পাতাগুলো বেপরোয়াভাবে ঘুরে ঘুরে তাকে উত্তেজিত করে তোলে। এদের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো কোনো শক্তিই তাঁর নেই। তাই তিনি চুপচাপ খাবারের লোভ সংবরণ করেন। এছাড়া আর উপায় কী!

[১]

ঘটনার শুরু প্রায় সাড়ে তিন যুগ আগে। তখন আয়ান নামের সাথে চৌধুরী যুক্ত ছিল না। তিনি ছিলেন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মানো সাধারণ একটি ছেলে। সেই পরিবারে অভাব ছিল কিন্তু অভাবের তীব্রতা খুব একটা ছিল না। সবচেয়ে বেশি ছিল যেটা, তা হলো “ভালবাসা”। বাবা, মা আর তাদের ছোট্ট ছেলে আয়ানকে নিয়ে ছিল একটি ভালোবাসাময় কুঠির। যেখানে সুখেরা হাত ধরাধরি করে তাদের উঠোনের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতো।

বেশ ভাল কাটছিল তাদের। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি চলে গেল ওপাড়ে, তার আপন গন্তব্যে। বিধবা গিন্নি তার ছেলেকে নিয়ে পড়ল বিপাকে। সুখগুলো যেন রাস্তা হারিয়ে ফেললো, আর বেড়াতে আসতো না তাদের আঙিনায়। ভালোবাসার তীব্রতা ছাপিয়ে সেই জায়গা দখল করে নিল অভাব। অভাবের তীব্রতা দিনকে দিন বাড়তে লাগলো।

বিত্তশালী আত্মীয়দের করুণামাখা চাহনি ছিল। কিন্তু সত্যিকারের সাহায্যের হাতটি আর কেউ বাড়িয়ে দেয়নি। দিশেহারা মা-ছেলে উঠোনের এক কোণায় কর্তার কবরের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতো। কখনো কখনো দু’জনের চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রুজল গড়াতো, কখনো বা বেরিয়ে আসতো একটি দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু এভাবে আর কয়দিন?

গিন্নি সব দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে নেমে পড়লো জীবন বাঁচানোর তাগিদে। আগে থেকেই জানা সেলাই এর কাজ এখন শুরু করলো পেশাদার দর্জি হিসেবে। তার ভালো কাজ দেখে গ্রামের মহিলারাও ছুটে আসতো তাদের পরিধেয় কাপড় নিজের মতো করে বানিয়ে নিতে।

কিন্তু গিন্নি প্রায়ই অসুস্থ হয়ে যেত। খুব বেশি কাপড় সেলাই করতে পারতো না। তাই টাকাও কম আসতো। এই সামান্য টাকায় ছেলের পড়াশুনার খরচ ও সংসার চালাতে বেশ হিমশিম খেতে হত। তবে তার ছেলেটি ছিল একটি সোনার টুকরো। মাত্র ১০ বছর বয়সী এই ছেলে যেন সব বুঝতো। শান্তশিষ্ট ছেলেটি কখনো তার মায়ের কাছে কোনো আবদার করতো না। না খেয়ে থাকলেও কারো কাছে কিছু চাইতো না। পড়াশুনায়ও খুব ভাল ছিল।

[২]

একবার কুরবানি ইদের একটি ঘটনা। এই ইদের সপ্তাহ খানিক আগে আয়ানের মা প্রচন্ড জ্বরে শয্যাশায়ী। কাপড় অনেক জমে আছে কিন্তু সেলাই করার মতো শরীরে কোনো শক্তিই অবশিষ্ট নেই। তারপরও সে উঠে গিয়ে মেশিনে বসে। একটু সেলাই করে, একটু দম নেয় আবার কখনো বা মেশিনেই মাথা দিয়ে চোখ বুজে থাকে। এভাবে অল্পসল্প কাপড় সেলাই করতে করতেই ইদ চলে আসে। কিন্তু হাতে এত টাকা নাই যে সস্তায় বেঁচা মুরগির চামড়া আর পাগুলো বাজার থেকে এনে আলু দিয়ে রান্না করবে। তাতে যদি ছেলেটার মন ভরতো!

গত ইদে সে তাই করেছিল। আয়ানও মজা করে একদম চেটেপুটে খেয়েছিল। কিন্তু এবার যে সেটাও হবে না। এসব ভেবেই সে আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলো। এমন সময় আয়ান দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল।

খুশিতে ছেলেটার চোখ চিকচিক করছিল। এত খুশি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতেই জানালো, তার চাচাদের গরু জবাই করা এবং গোস্ত কাটা সে দূর থেকে দেখছিল। বড় চাচা তাকে দেখতে পেয়ে আজ দুপুরে তার বাসায় খেতে বলেছে। অনেকদিন পর গরুর মাংস খাবে এই খুশিতে সে একদম আত্মহারা।

বুঝদার ছেলেটি তার মাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছে তাকে গোস্তের দুইটা পিচ দিলে পকেটে করে একটা মায়ের জন্য নিয়ে আসবে। মা হাসতে লাগলো ছেলের কথা শুনে।

[৩]

পুরোনো কিন্তু ভালো একটা ফতুয়া গায়ে চাপিয়ে পরিপাটি হয়ে সে চাচার বাসার গেটে গিয়ে দাঁড়ালো ঠিক দুপুরবেলা। অনেক্ষণ পর বাইরে থেকে তার চাচা এলেন। আয়ানকে বাসার ভিতরে নিয়ে গেলেন না। ফটকের সামনে অপেক্ষা করতে বলে তিনি ভিতরে চলে গেলেন।

আয়ান ওখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো কিন্তু ফটকের দরজাও কেউ খোলে না, আর চাচাও বাইরে আসেন না। এদিকে খিদের জ্বালায় সে বসেই পড়লো দরজার সামনে। এভাবেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগে সে দরজা খোলার শব্দ পেল। খুশিতে সবকিছু এক নিমিষেই ভুলে যায়। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে তার চাচা বের হচ্ছেন সপরিবারে।

আয়ানকে দেখে চাচা বললেন, “আরে তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস? আমি তো তোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিছু মনে করিস না, বাবা। তুই বাড়িতে চলে যা। আমরা একটু ঘুরতে বের হচ্ছি।”
এই বলে তারা সবাই বেরিয়ে গেলেন। আয়ান শুধু ঝাপসা দৃষ্টিতে তাদের চলে যাওয়া দেখছিল।

.
এই সেই ঘটনা। এরপর এক যুগ এক যুগ করে তিনটি যুগ পার হয়েছে, আয়ান থেকে তিনি আয়ান চৌধুরী হয়েছেন। এখনও তিনি গরুর মাংস মুখে তুলতে পারেন না। ঐদিনের স্মৃতি আজও তাঁর চোখে জল নিয়ে আসে।

“দুই টুকরো গরুর মাংস”
লেখা: মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া।

Leave a Comment