দেশের বৃহৎ শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে চাচ্ছে না বেসরকারি ব্যাংকগুলো। চাহিদামতো ঋণ না পেয়ে ব্যাহত হচ্ছে শিল্প খাতের বিনিয়োগ। ফলে সরকার বিনিয়োগ বাড়াতে ঋণের সুদের হার কমালেও এর সুফল পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। সরকারের কাছ থেকে ডিপোজিটসহ বিভিন্ন সুবিধা নিয়েও শিল্প খাতে বিনিয়োগে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না এসব বেসরকারি ব্যাংক। অথচ দেশের ৬৭টি তফসিলি ও বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে ছয়-সাতটি সরকারি ও বিশেষায়িত ব্যাংক ছাড়া বাকি সবই বেসরকারি ব্যাংক। দেশে শিল্প স্থাপনসহ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য সরকার দফায় দফায় বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে।
এদিকে করোনার চলমান প্রাদুর্ভাবের কারণে সারা বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক সংকট চলছে, তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমিক দেশে ফেরত আসছেন। বর্তমান সরকার এই শ্রমিকদের পুনর্বাসনসহ নতুন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এবং দেশকে উন্নয়নশীল ও মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার তাগিদে শিল্প স্থাপনের জন্য উদ্যোক্তাদের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি ১০০টি ইকোনমিক জোন স্থাপনের জন্য অনুমতি দিয়েছে। এসব ইকোনমিক জোনে শিল্প স্থাপন করতে গেলে উদ্যোক্তাদের ইকুইটির পাশাপাশি ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানে যথেষ্ট অনাগ্রহ রয়েছে বলে শিল্প উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। এসব ব্যাংক সিন্ডিকেট লোন প্রদানের জন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রস্তাব পাঠালে বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংক টালবাহানা করে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করে অথবা ঋণ প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করে। এ ছাড়া সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালীসহ চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক প্রকল্প স্থাপনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। কারণ ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সিঙ্গল বরোয়ার এক্সপোজারে এসব ব্যাংকের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সরকারি পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে। এসব ব্যাংকের এমডিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা বলেন, সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংক এগিয়ে না এলে এ থেকে উত্তরণ কোনোভাবে সম্ভব হবে না এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশকে এগিয়ে নেওয়ার যে ভিশন হাতে নিয়েছেন, তা কোনোভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
এসব বিষয়ে বিভিন্ন শিল্প উদ্যোক্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানিয়েছেন, তাঁরা করোনাকালীন সংকটের মধ্যে উৎপাদন চালু রাখতে বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ করছেন। নতুন বিনিয়োগের জন্য উদ্যোক্তাদের নানা দরজায় দৌড়ঝাঁপ করেও ব্যাংকিং সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভয়াবহ সংকটে পড়তে হয়। শিল্প বিনিয়োগের জন্য জরুরি মেয়াদি ঋণ পাওয়া এখন সবার জন্য কঠিন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ছাড়া বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংক মেয়াদি ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র চারটি। এই চার ব্যাংকের ওপর সব ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাকে ভরসা করতে হয় মেয়াদি ঋণের জন্য। আর মেয়াদি ঋণ ছাড়া কোনো শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। মাত্র চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর চাপ যেমন বেশি, তেমনি তাদের সক্ষমতার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিপরীতে বেসরকারি খাতে ৬৩টি ব্যাংকের সবগুলোই সহজ ব্যাবসায়িক ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী। এর মধ্যে আছে ক্ষুদ্রঋণ, এসএমই ঋণ, ব্যক্তিগত ঋণ, কনজ্যুমার ঋণ। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের কার্ডভিত্তিক বাণিজ্যে মুনাফা তুলছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। শিল্পঋণের ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা চলতি মূলধন দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি এসব চলতি মূলধন দেশে নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে মূলত গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে না। চলতি মূলধন দিয়ে সাধারণত কাঁচামাল, ইউটিলিটি, বেতন-ভাতা বা খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয়ের কাজ চলে।
গত মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে মোট ব্যাংকঋণের পরিমাণ হচ্ছে ১১ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে বেসরকারি শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ তিন লাখ কোটি টাকার মতো। এই তিন লাখ কোটি টাকার মধ্যে বেশির ভাগ অংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। দীর্ঘমেয়াদি শিল্পঋণ ৬৩টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সম্মিলিত পরিমাণ এর চেয়ে কম।
দেশের শিল্প বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে বেসরকারি খাতে ব্যাংকের অনুমতি দিলেও সরকারের সেই উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। এসব বেসরকারি ব্যাংক কিছু মালিকের সুবিধার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অনেক ব্যাংকের বিরুদ্ধে এনজিওর মতো ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে অধিক মুনাফা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। যেখানে বড় ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের সুবিধা দিতে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হচ্ছে, যা আগে ছিল শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে; সেই টাকা ব্যাংকগুলো অধিক মুনাফার ব্যবসায় লগ্নি করছে, যা দেশের শিল্প বিনিয়োগ উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
জানতে চাইলে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘শিল্প বিনিয়োগের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ খুবই জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন ছাড়া শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা কঠিন। ব্যবসা করাও কঠিন। আমাদের দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ভাব দেখলে মনে হয়, স্বল্প সময়ে ব্যবসা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে চায় না। দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য আলাদা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাংক করা প্রয়োজন। স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ নিয়ে কখনো দেশের বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব নয়। আর বর্তমান অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি শিল্প খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ছাড়া কোনোভাবেই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব নয়। দেশে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে শিল্পায়ন করতে হবে। আর শিল্পায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ভূমিকা রাখা দরকার। তাহলে দেশকে উন্নত দেশগুলোর কাতারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।’