দিনভর যানজট, ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দখলে

ছোট ছোট যানবাহনের চাপে কুমিল্লা নগরের প্রধান সড়কগুলোতে যানজট লেগেই থাকে। এর ওপর সরু সড়ক ও ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দখলে থাকায় পথচলাই দায় হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা নগরবাসীকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।
এদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে কুমিল্লা এখন ঘিঞ্জি শহরের রূপ নিয়েছে। কোথাও বাসিন্দারা, কোথাও খোদ সিটি করপোরেশনই নিয়ম ভেঙে নানা স্থাপনা করছে। হয়নি সুয়ারেজ–ব্যবস্থাও। এ অবস্থায় পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার এক দশকেও নিয়ম মেনে এগোতে পারেনি কুমিল্লা নগর। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, অনিয়মেই এগোচ্ছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন। নগরে দুর্ভোগ কমেনি।বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ রংপুর ডেইলীকে বলেন, পুরো নগরি ঘিঞ্জি পরিবেশে গড়ে উঠেছে। কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই ভবন হচ্ছে। এগুলো রোধ করা হয়নি। এখানে কোনো নিয়ম মানা হয় না। যে কারণে অনিয়মের মধ্যেই সবকিছু হচ্ছে।

যানবাহন ও যানজট দুই–ই বেড়েছে
২০১৭ সালের ৩০ মার্চ দ্বিতীয় মেয়াদে বিএনপির প্রার্থী মো. মনিরুল হক ওরফে সাক্কু মেয়র পদে জয়ী হন। তখন তিনি ২৭ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। এর মধ্যে প্রথম দফা ছিল নগরের যানজট নিরসন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যানজট নিরসনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি। উল্টো ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলে নমনীয় মনোভাব দেখিয়েছেন। এতে নগরের ১৮টি ওয়ার্ডের ১৪৭ কিলোমিটার সড়কে যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে গেছে। প্রধান সড়কগুলোতে সারাক্ষণই যানজট লেগে থাকে। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি কমার প্রেক্ষাপটে সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর গ্রাম থেকে শহরে কয়েক হাজার যানবাহন প্রবেশ করে।


গত সোমবার দুপুরে টানা দুই ঘণ্টা এই প্রতিবেদক নগরের অন্তত আটটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অবস্থান করে দেখতে পান, নগরের রাজগঞ্জ মোড়ের এক পাশ ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দখলে। সড়কে যানবাহনের জটলা। কান্দিরপাড় পুবালী চত্বর ঘিরে যানজট তার চিরচেনা রূপেই আছে। টমছম ব্রিজ এলাকায় চারদিকের যানবাহনের চাপ ও ইপিজেডের ভারী বাহনের কারণে নগরবাসীকে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে দেখা গেল। জাঙ্গালিয়া বাস টার্মিনালে বাস না ঢুকে সড়কের মধ্যে থেকেই যাত্রী ওঠানো–নামানো করে। চকবাজারে, নজরুল অ্যাভিনিউ মোড়ে, নিউমার্কেটের সামনে ও বাদশা মিয়ার বাজারে ভয়াবহ যানজট লেগে আছে। এতে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাস চলতে হিমশিম খাচ্ছে।কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়া খোন্দকার বলেন, ‘ইজিবাইকের উত্পাতের কারণে ব্যক্তিগত গাড়ি চালাতে পারি না। রিকশায় চলাচল করি। সড়কে কোনো শৃঙ্খলা নেই।’নগর ভবন সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লা নগরে নিবন্ধন করা রিকশার সংখ্যা ১০ হাজার ৫৩০টি। ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশার কোনো নিবন্ধন নেই। নিবন্ধনের বাইরে চলছে সিএনজিচালিত অটোরিকশাও। ২০১২ সালে নগরের ৮৩টি পয়েন্টকে ধরে রিকশাভাড়া নির্ধারণ করা হয়। সেটি মানছেন না চালকেরা।

দুপুরে নগর ভবনে কথা হয় মেয়র মো. মনিরুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যানজট নিরসন করতে গেলে বহু লোক বেকার হয়ে যাবে। এতে ছোট ছোট যানবাহন নিয়ে সড়কে নামা বাহনের চালকেরা কর্মহীন হয়ে পড়বে। এরপরও আমরা যানজট নিরসনের চেষ্টা করছি। আমরা চাই সকালে অর্ধেক বাহন চলুক, বিকেলে বাকি অর্ধেক।’কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের লাইন্সেস পরিদর্শক কাজী আতিকুর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশনে নিবন্ধিত পায়েচালিত রিকশা আছে ১০ হাজার ৫৩০টি। এর বাইরে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করে। অন্তত ২০ হাজারের মতো ইজিবাইক আছে।এদিকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কুমিল্লা সূত্রে জানা গেছে, গোটা জেলায় ১৯ হাজার ৪৮৮টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা আছে। এর মধ্যে কুমিল্লা নগরে হাজারের মতো সিএনজিচালিত অটোরিকশা আছে। এর বাইরে নিবন্ধন ছাড়াও চলে।

ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দখলে
কুমিল্লা নগরের ৬৫ কিলোমিটারের মধ্যে বেশির ভাগ ফুটপাতই ব্যবসায়ীদের দখলে। তাঁদের মধ্যে মাঝারি, এমনকি বড় ব্যবসায়ীও আছেন। অবশ্য ফুটপাতে বসে ব্যবসায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দাপটই বেশি। তার ওপর ভ্যানগাড়িতে পণ্য বিক্রির কারণে নগরবাসীর হাঁটার পথও সংকুচিত হয়ে এসেছে। নগরের কান্দিরপাড় লিবার্টি সিনেমা হল মোড় থেকে রাজগঞ্জ পর্যন্ত দুই পাশের ফুটপাত আশপাশের দোকানদারদের দখলে। তাঁরা মালামাল ফুটপাতে সাজিয়ে রেখেছেন। কান্দিরপাড়ের পুবালী চত্বরের চারদিকে একই অবস্থা। কান্দিরপাড় থেকে পুলিশ লাইনস পর্যন্ত একই চিত্র। ছাতিপট্টি এলাকায় কিশোর স্টোর, পুষ্প ক্রোকারিজ, বারদা ভান্ডার, চাঁদনী জুয়েলার্সের সামনে, গৌতম ভান্ডারের সামনে জুতা, শীতের কাপড় ও নানা ধরনের পণ্য তুলে রাখা হয়েছে। রাজগঞ্জ থেকে থানা সড়ক পর্যন্ত কলা ও ফল ব্যবসায়ীদের দখলে।


কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সড়ক প্রশস্তকরণ, ফুটপাত রাখতে হলে অপরিকল্পিত সব ভবন সিঙ্গাপুরের মতো ভেঙে ফেলতে হবে। এখনো সময় আছে মহাপরিকল্পনা ধরে কাজ করার। প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজ এককাট্টা হলে এটা সম্ভব।’ফুটপাত দখলমুক্ত করা প্রসঙ্গে মেয়র মনিরুল হক রংপুর ডেইলীকে বলেন, ‘কান্দিরপাড়ে ফুটপাত থেকে খুদে ব্যবসায়ীদের তুলে দেওয়া হয় কয়েক দফা। তাঁরা আমাদের কথা শুনছেন না। আমার কাছে ম্যাজিস্ট্রেট নেই। সিটি করপোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেট থাকলে তাঁদের তুলে দেওয়া যেত।’

Leave a Comment