দাওয়াহর অজুহাতে গুনাহয় লিপ্ত হবেন না

দাওয়াহর অজুহাতে গুনাহয় লিপ্ত হবেন না :

কিছু মানুষ নিজেদের সাথে প্রতারণা করে। আল্লাহ ﷻ-এর সাথে প্রতারণা করা যায় না, তাই তারা আসলে নিজেদেরকেই প্রতারিত করে। নিজেদের গুনাহ আর ভুল, অবস্থানগুলােকে তারা দাওয়াহর অজুহাতে জায়েজ করতে চায়।

যেখানে মদ পরিবেশন করা হচ্ছে আপনি সেখানে থাকতে পারবেন না। মদের টেবিলে বসে আপনি দাবি করতে পারেন না যে, আপনি সেখানে দাওয়াহর জন্য বসে আছেন।

উমার (রাঃ)-এর কাছে এমন একটি ঘটনার ব্যাপারে অভিযােগ এসেছিল। যারা মদ খেয়েছিল তাদের আগে যারা মদ খায়নি তিনি তাদের বেত্রাঘাত করার আদেশ দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ যখন বলল তারা সাওম পালন করছে, উমার (রাঃ) আগে সাওম পালনকারীদের শাস্তি দেবার আদেশ দিয়েছিলেন।

একজন মুসলিম ভাইয়ের কখনাে উচিত না অমার্জিত, অশালীন পােশাক পরা নারীদের কাছে গিয়ে দাওয়াহ দেয়া বা একা একা নির্জনে কোনাে বােনকে কুরআন শিক্ষা দেয়া। এমন কাজ করা যাবে না এবং এটাকে দাওয়াহও বলা যাবে না।

আজ এমন অনেকে আছে যাদের দেখে মনে হবে এরা মডেল হবার চেষ্টা করছে — টাইট জিন্স পরে, মাথায় কাপড় পাঁচিয়ে হাতে লিফলেট নিয়ে এরা মানুষের সামনে যাচ্ছে আর বলছে, এটা দাওয়াহ!
না, এমন করা যাবে না।

বিষয়টি নিয়ে আমি আলােচনা করছি কারণ আজ এগুলাে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
যেমন : মুসলিমদের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলােতে এ ধরনের ব্যাপারগুলাে আজ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। যেহেতু এ ধরনের কাজ যারা করছেন তারা সালাত আদায় করেন, তাই আমরা তাদের কাফির বলতে পারি না।
কিন্তু জেনে রাখুন, এ রকম আচরণ কবীরা গুনাহ।

বিয়ের অনুষ্ঠানগুলােতে সব রকমের গানবাজনা থাকে। থাকে নিসাউন কাসিয়াতুন আরিয়াত [১], নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, আর নারীদের এমন বেশভূষা যা দেখা গায়রে মাহরামের সম্পূর্ণ নাজায়েয। অথচ অনেকে এমন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন, দিব্যি অবস্থান করছেন এমন পরিবেশে।

আপাতদৃষ্টিতে বেশ ধার্মিক, দ্বীনদার ভাইদেরও এমন করতে দেখা যায়। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এখানে তিনি কী করছেন, কেন তিনি এমন একটা জায়গাতে স্বেচ্ছায় অবস্থান করছেন?
উত্তর আসবে, দাওয়াহর খাতিরে।
এটা প্রায়শই দেখা যায়।

আমি বলছি না যে সবাই এ রকম কাজ করে, কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় বিয়ের অনুষ্ঠানের ফিতনাময় পরিবেশে অবস্থানের জন্য দাওয়াহর অজুহাত দেয়া হচ্ছে।

এ রকম পরিবেশে যাওয়া কেবল তখনই জায়েজ হবে যখন আপনি জানেন যে এসব হারাম কাজ থেকে তাদের আপনি বিরত রাখতে পারবেন।
আর এটা হলাে আমর বিল মারুফ আর নাহি আনিল মুনকার — সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের সর্বোত্তম পন্থা।

যদি আপনি নিশ্চিত হন আপনার কথা শুনে তারা এসব বন্ধ করবে, তাহলে আপনার যাওয়া কেবল উচিতই নয়, বরং আপনাকে যেতে হবে এবং তাদের এসব কাজ থেকে বিরত করতে হবে।

আর যদি আপনি জানেন যে তারা আপনার কথা শুনবে না, তাহলে আপনার এসব জায়গায় অবস্থান করা উচিত না।

চার মাযহাবের ফিকহের কিতাবাদি —দুররুল মুখতার, মালিকি মাযহাবের আদ-দুসুকি, আশ শিরাজির আল মুহাযযাব, ইবনু দ্বইয়্যান-এর মুবদা এবং ইবনু কুদামার আল-মগনি খুলে দেখুন।
দেখবেন বলা হয়েছে,
কোনাে মুনকার বা মন্দ কাজ থামানাের সামর্থ্য থাকলে তা করা উচিত, আর তা না হলে এমন কোনাে জায়গায় অবস্থান করা উচিত না যেখানে গুনাহ হচ্ছে।
আপনাকে নিমন্ত্রণ করা হলেও না।

আমি আলাদা করে নিমন্ত্রণের ব্যাপারটা উল্লেখ করলাম, কেননা অধিকাংশ আলিমের মত হলাে একজন মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের দাওয়াত বা নিমন্ত্রণ রক্ষা করা ওয়াজিব।

তাহলে দেখুন, যদিও নিমন্ত্রণ রক্ষা করা ওয়াজিব, কিন্তু যখন সেটা এমন জায়গাতে হয় যেখানে প্রকাশ্যে গুনাহ ও ফাহিশা চলছে, তখন সেখানে যাওয়া আর ওয়াজিব থাকে না।

যে কিতাবগুলাের কথা ওপরে বললাম সেগুলােতে বলা আছে এ রকম ক্ষেত্রে ওয়াজিব পরিবর্তিত হয়ে হারাম হয়ে যায়।
অর্থাৎ আপনি যদি সেখানে গিয়ে গুনাহ বা ফাহিশা বন্ধ করতে না পারেন, তাহলে সেখানে যাওয়া আপনার জন্য হারাম।

আমাদের এমন অনেক ভূখণ্ড আছে, যেগুলাে দখল হয়ে আছে আজ অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময়জুড়ে।
এর মধ্যে এমনও ভূমি আছে, যেখানে অবস্থিত আমাদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ।

‘…মুক্ত করাে! মুক্ত করাে!’ — স্লোগান দেয়ার অনেকে আছে।
মুক্ত করা নিয়ে তারা বিস্তর কথা বলে। কিন্তু সব কথা শেষ হবার পর, বাস্তবতার মুখােমুখি দাঁড়াতে হয়।
প্রশ্ন করতে হয়,
কেন উম্মাহর দুর্বল শরীর আজ এ নর্দমায় এসে ঠেকেছে?
পবিত্র ভূমিকে ঘিরে যা হচ্ছে, কেন তা এত বছর ধরে চলছে?
কেন লজ্জা আর
অপমানের মধ্যে দিয়ে আমাদের এতগুলাে বছর অতিক্রম করতে হচ্ছে?
আমাদের উচিত চিন্তা করা, বিশ্লেষণ করা।

ধরুন একটি কোম্পানি লস করল। তখন কী হয়?
কোম্পানির সিইও তার ম্যানেজার আর অন্যান্য উচ্চপদস্থ অফিসারদের নিয়ে মিটিংয়ে বসে।
মিটিংয়ে সিইও সাধারণত ধরাবাঁধা কিছু প্রশ্ন করে :

কী করা যায়?

কোন স্ট্র্যাটিজি অনুসরণ করলে আগের মতাে প্রফিট করা যাবে?

আমরা এখন যা করছি তার মধ্যে কী কী পরিবর্তন আনা দরকার?

মুসলিম-অমুসলিম সব জেনারেলরাই যুদ্ধে পরাজয়ের পর নিজেদের একটা ট্যাকটিকাল প্রশ্ন করে —
আমরা এ যুদ্ধে কেন হারলাম?

এ হারের পেছনে কী কারণ ছিল?

একই রকমভাবে ১.৬ বিলিয়নের মুসলিম উম্মাহ, ছয় কিংবা বড়জোর ১৬ মিলিয়নের একটি জাতির কাছে পরাজয়, লাঞ্ছনা আর অপমানের তিক্ততম স্বাদ অনুভব করে,
তখন আমাদেরও প্রশ্ন করা দরকার :
কেন?

সাহাবি (রা.) গণও পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন।
উহুদের যুদ্ধে সাময়িক এই পরাজয়ের কারণ সম্পর্কে তারা নিজেদের প্রশ্ন করেছিলেন,

‘যখন তােমাদের ওপর একটি মুসিবত এসে পৌছাল, অথচ তােমরা তার পূর্বেই দ্বিগুন কষ্টে পৌঁছে গিয়েছ, তখন কি তােমরা বলবে, এটা কোথা থেকে এল?
তাহলে বলে দাও তােমাদের ওপর পৌঁছেছে তােমাদেরই পক্ষ থেকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ের ওপর ক্ষমতাশীল।’
( সূরা আলি ইমরানঃ ১৬৫ )

যেভাবে আমরা চিন্তা করছি কেন আজ আমরা অধঃপতনের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছি, ঠিক তেমনিভাবে উহুদের পরাজয়ের পর মদীনা ফেরার পথে সাহাবি (রা.) গণও প্রশ্ন করেছিলেন —
কেন?
কেন আমাদের সাথে এমনটা হলাে?

কোন স্ট্র্যাটিজি অনুসরণ করলে আমরা হার এড়াতে পারব?

আমরা কেন হারলাম?
কী কী কারণে?

মদীনায় পৌঁছানাের আগেই আল্লাহ ﷻ তাদের প্রশ্নের জবাব দিলেন।

‘তাহলে বলে দাও, এ কষ্ট তােমাদের ওপর পৌঁছেছে তােমাদেরই পক্ষ থেকে।’

আল্লাহ ﷻ বলেন :
‘তােমার রব বান্দাদের প্রতি কোনাে যুলম করেন না।’
( সূরা ফুসসিলাতঃ ৪৬ )

নিজেকে যাচাই করে দেখুন। উপকরণের মাধ্যমে মুক্তি আসে না; বরং শয়তানের তৈরি উপকরণ অধঃপতন ডেকে আনে।
শয়তানের তৈরি পদ্ধতি দিয়ে দখল হয়ে যাওয়া ভূখণ্ড মুক্ত করা সম্ভব না।
শয়তানের তৈরি ব্যবস্থা মুক্তির উপায় না; বরং অধঃপতনে কারণ।

আপনি কার কাছ থেকে বিজয় আশা করছেন?
কোন বিজয় আশা করছেন?
বিজয় কে দেবে?

[১] নিসাউন কাসিয়াতুন আরিয়াতঃ

এমন নারী, যে কাপড় পরেও উলঙ্গ।

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
” দুই প্রকার জাহান্নামী মানুষ আসবে, যাদের আমি আমার যুগে দেখতে পাচ্ছি না।
এক প্রকার হচ্ছে, ওই সমস্ত ব্যক্তি, যাদের হাতে গরুর লেজের মতাে লাঠি থাকবে, তা দিয়ে তারা মানুষকে পেটাবে।
আর দ্বিতীয় হলাে, ওই সকল মহিলা যারা কাপড় পরিধান করেও উলঙ্গ থাকবে। তারা সাজসজ্জা করে পরপুরুষকে আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও অন্য পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথার খােপা (সাজসজ্জা ও ফ্যাশনের দরুন) উটের কুজের মতাে এদিক-ওদিক হেলানাে থাকবে।
তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি তারা জান্নাতের সুগন্ধিটুকুও পাবে না।
অথচ,জান্নাতের সুগন্ধি পাঁচ শবছর রাস্তার দূরত্ব থেকেও অনুভব করা যাবে। ”
( সহিহ মুসলিমঃ ৫৭০৪ )

– শাইখ আহমাদ মুসা জিবরিল হাফিজাহুল্লাহ

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *