তাদের আত্মসম্মানবোধ

সেদিন নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই প্রাইভেট শেষ হলো।

সরাসরি অটোতে না উঠে কারমাইকেলের ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটতে লাগলাম। মাঝেমাঝে এভাবে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আর যদি সামনে পাই সবুজাভ প্রকৃতির ছোঁয়া, তাহলে তো কথাই নেই।

সময় দেখতে ব্যাগের চেইন খুলে ফোনটা হাতে নিলাম। সকাল ১০টা বেজে আরো কিছু মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেছে। ভাবলাম কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করব, প্রকৃতির সাথে সময় কাটাবো আর অনুভব করব রবের দেয়া সমূহ নিয়ামাহ।

হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়ালাম কিছু ছোটছোট ছেলেমেয়েদের দেখে। ওদের হাতভর্তি শাপলা ফুল। আমি একটু দ্রুত হেঁটে ওদের কাছে এগিয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
-এই তোমরা কোথায় পেলে এতগুলো শাপলা ফুল?
: ঐ যে সামনে পুকুর আছে না, ওখান থেকে তুলেছি। (ওদের একজন উত্তর দিল)

আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ওরা হাঁটতে লাগলো। আমি ওদের থামতে বললাম। থামলো তারা।

এরই মাঝে এক আপু এসে জানতে চাইলো, ফুলগুলো কত করে বিক্রি করছো? ওরা বললো, দুইটা ১০টাকা। আপুটি টাকা দিয়ে ফুল নিয়ে চলে গেলো।

আমি তাদের বললাম, আমি কি তোমাদের কিছু ছবি তুলতে পারি? তারা খুব খুশি হয়ে সম্মতি জানালো এবং একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। আমি বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম।

এরই মাঝে ডানের শুরুতে যে ছেলেটা সে বললো, আপু দেখি ছবিগুলো কেমন হলো। আমি দেখালাম সবাইকে। লক্ষ্য করলাম সবার মুখজুড়ে কি স্নিগ্ধময় হাসি! ওদের সেই পবিত্র হাসি আমার অন্তর ছুঁয়ে গেলো।

কিছুক্ষণ বাদে ওদের জিজ্ঞেস করলাম, বাসা কোথায়, সকালে কিছু খেয়েছে কি না। জানালো, রেল লাইনের পাশের বস্তিতে ওরা থাকে আর এখনো কেউ কিছু খায়নি।

আমি কোনো কিছু না ভেবেই চটজলদি ওদের বললাম, চলো আজ আমি তোমাদের খাওয়াবো। কী কী খেতে চাও বলো?

বলার পর আমার মনে পড়লো, আরে যাতায়াত ভাড়া আর ঔষধ কেনার টাকা ছাড়া তো আমার কাছে আর কোনো টাকা নেই! আমি মনে মনে হিসেব কষলাম। দরকার হলে কিছুটা পথ হেঁটে যাব আর মেডিসিন কেনার টাকা আল্লাহই ম্যানেজ করে দিবেন।

যাহোক, আমার থেকে এমন কিছু শুনবে ওরা হয়তো আশা করেনি। খানিকটা বিষ্ময়মাখা চাহনি নিয়ে আমার দিকে তাকালো চার জোড়া চোখ। তারপর ওরা একে অন্যের সাথে চোখাচোখি করে আমাকে যা বললো, তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, সুবহানাল্লাহ!

ওরা আমাকে বললো, “না আপু, আমরা খাব না। বাড়িতে গিয়েই খাব। তার চেয়ে আপনি বরং আমাদের থেকে দুটো ফুল উপহার নিন।”

আমি বিষ্ময়ে হতভম্ব হয়ে ওদের বললাম, আরে না না! অল্প কিছু খাও, চলো? নাহলে চলো চকলেট কিনে দেই তোমাদের।

কিন্তু ওরা আমার কথা না শুনে দৌঁড়ে চলে যাচ্ছিলো। আমিও ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে জোরে জোরে হেঁটে তাদের কাছাকাছি গেলাম।

অনেক করে বললাম, চলো না প্লিজ। আসো, আমিও তোমাদের সাথে খাব। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা, আমার কোনো কথাই শুনলো না। ওরা গল্প করতে চলে যাচ্ছিলো। আমি অনেকটা পথ তাদের সাথে হেঁটে গেলাম আর অনুরোধ করতে থাকলাম। কিন্তু ওরা অনড়!

আমি রাস্তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখছিলাম।

আমার কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছিলো।

অনেকক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এরপর অটোতে বসে সারা রাস্তায় শুধু ওদের নিয়েই ভাবলাম।

যেখানে এমন পিচ্চি পিচ্চি ছেলেমেয়েরা মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করে, সেখানে এই বাচ্চাগুলো আত্মসম্মানবোধে কতটা সচেতন! ওরা জানে বাসায় গিয়ে হয়তো তেমন ভালো খাবার জুটবে না তবুও আমার করা অফার প্রত্যাখ্যান করলো।

আল্লাহ তাদের সঠিক ও সরল পথে পরিচালিত করুন। বড় হয়ে ওরা যেন মানুষের মত মানুষ হতে পারে, ইয়া রব। তাদের আপনি সকল প্রকার বিপদ থেকে হেফাজত করুন।

#জীবন_থেকে_নেয়া কিছু
টুকরো স্মৃতিকথা।
✍️মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া
১০.১০.২০২২

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *