ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক থাকলেই ঠিক পথে বাংলাদেশ

আগেও কোথাও কোথাও লিখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ওঠার সময় একটা ইন্টারভিউ দিতে হয়েছিল। এক পাতি ছাত্রনেতার কাছে। সংলাপগুলো এ রকম, ‘এই প্যান্টে চলবে না। জিন্সের প্যান্ট নেই?’

‘আছে ভাই।’

‘আর এই চুলেও হবে না।’

‘চুলে কী সমস্যা ভাই?’

‘এই তেল দেওয়া আঁচড়ানো চুল বদলাতে হবে। দুটি স্টাইল আছে। একটি হচ্ছে সাইড পাতলা, আর্মি স্টাইল। আরেকটি লম্বা চুল, পাংকু স্টাইল।’

‘পাংকুটা পারব না, আর্মি স্টাইলই ভালো।’

‘আর এভাবে দাঁড়ালে হবে না। বুক থাকতে হবে ফোলা।’

‘বুক ফুলাব।’

কাজেই জিন্সের প্যান্ট চাপিয়ে, চুল যথাসাধ্য আর্মি স্টাইল বানিয়ে, বুক ফুলিয়ে এক সন্ধ্যায় হলে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর ঠিক আমারই মতো জিন্স-চুল-বুকের শর্ত মানা আরেকজন এসে হাজির। তাতেও সমস্যা ছিল না। হলের সিঙ্গল সিটে প্রথম বর্ষে দুজন করে থাকতে হয় তা তখন ভালোমতো জানি। সমস্যা দেখা দিল যখন তৃতীয় আরেকজন এসে অবাক হয়ে আমাদের দুজনকে অবাক চোখে দেখতে থাকল। আমরাও তাকে দেখতে থাকলাম। দেখাদেখি শেষে জানা গেল, এটা তারই সিট। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক গ্রুপ এখানে দুজনকে তুলে দিয়েছে।

সেই ছাত্রটির মধ্যে ভালোমানুষি লক্ষ করে আমাদের একটু বাধোবাধো লাগল। বললাম, ‘আপনি প্রতিবাদ করেন।’

‘আরে আমাকে অত বোকা ভেবেছ?’

‘মানে…’

‘ওরা তো সেটাই চাইছে। আমি প্রতিবাদ করি আর আমাকে মার দেয়। আর মার মানে বোঝো তো…ওদের হাতে জিনিসপত্র আছে প্রচুর।’

জিনিসপত্র মানে পিস্তল-বন্দুক। কাজেই সেই বড় ভাইটি কোনো ঝামেলায় না গিয়ে আত্মসমর্পণ করে নিজের বালিশটা সঙ্গে নিয়ে আত্মগোপনে চলে গেলেন। আমরা রয়ে গেলাম। আর বীরবিক্রমে মিছিল-মিটিং করে সিট ধরে রাখলাম।

এই হলো সাধারণভাবে হলে ওঠার প্রক্রিয়া। প্রভোস্ট আছেন, হাউস টিউটর, হল ছাত্র সংসদ কত কী! কিন্তু প্রথম দিনেই বুঝে গেলাম এরা সব কেতাবের গরু। বাস্তবে অস্ত্রধারী ক্যাডাররাই হলের মালিক। এদেরই শাসন মেনে চলে হল প্রশাসন নিধিরাম হয়ে বসে। সেই নিধিরামরা স্যুটটুট পরে ঘুরে বেড়ান আর ক্ষমতাসীন দলের নানা রকম তেলবাজি করে আত্মরক্ষা করে চলেন।

হলে ওঠার কিছুদিন পরই দেখলাম দুই-তিন ব্যাচ সিনিয়র একজন প্রতিদিন সন্ধ্যায় কোথায় যেন সেজেগুজে যান। সেই সময় কোনো ছাত্রের সেজেগুজে সন্ধ্যায় বের হওয়া মানেই প্রেমে পড়ার ব্যাপার। খোঁচানোর জন্য এর চেয়ে আদর্শ কোনো বিষয় হয় না। কাজেই সহপাঠীরা ধরল তাঁকে। চলুন, শুনে আসা যাক সেই সংলাপগুলো—

‘প্রতি সন্ধ্যায় কোথায় যাওয়া হয়? আমরা কী বুঝতে পারি না!’

‘না, তোমরা যা ভাবছ বিষয়টা সে রকম নয়।’

‘তাহলে কী রকম?’

‘আমি যাই অমুকের বাসায় (যিনি তখনকার আমলের প্রখ্যাত একজন রাজনৈতিক নেতা)।’

‘প্রতি সন্ধ্যায় যাওয়ার দরকার কী? রাজনীতিতে তো তোমার আগ্রহ দেখি না।’

‘না, না, রাজনীতি করব না তো?’

তাহলে! চিন্তায় পড়ে গেলাম। এবং বিস্মিত হয়ে জানলাম, তাঁর লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া। তার জন্য শুধু ভালো রেজাল্ট করলেই হবে না, রাজনৈতিক ছায়া দরকার। ছায়ার সন্ধানে সন্ধ্যা কাটে নেতার বাসায়।

তিনি জীবনে সফল হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। এত দূর পৌঁছেছেন যে এখন আর যোগাযোগের মধ্যেই নেই।

এবার তৃতীয় গল্প। ২০০১ সালে নির্বাচনের সময়কার। সারা দেশে নির্বাচন যেমনই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রগুলোর নির্বাচন হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, সেই সূত্রে হলগুলোতে ছাত্রলীগেরই আধিপত্য। ভোটকেন্দ্রেও তাই। ওরাই নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হলের অনুপস্থিত ছাত্রদের ভোট নিজেরাই দিচ্ছে বা দেওয়াচ্ছে। সন্ধ্যার মধ্যে ফল আসা শুরু হতেই বোঝা গেল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরছে না। সত্যি বললে এত বড় ভরাডুবি ছিল বিস্ময়ের বিষয়; কিন্তু তার চেয়েও বিস্ময়ের বিষয় রাতের মধ্যেই দেখি হলগুলোতে ‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া লও লও লও সালাম’, ‘নেত্রী মোদের খালেদা জিয়া’ স্লোগান। ঘটনা কী! ছাত্রলীগও এভাবে দখল করেই হলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল; কিন্তু তা-ও তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার এক-দেড় বছর পর।

দেখতে গিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করাও কঠিন ছিল। এই দুপুরেও যারা নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে ভোট দিয়েছে, ওরাই সব এখন জিয়ার সৈনিক। ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের ছবি ভাঙচুর করছে। কৌতূহলী একজন বলল, ‘তোমরা? তোমরা না সব ছাত্রলীগ ছিলে?’

‘ছিলাম। এখন আর নেই।’

‘তাই বলে ছবি ভাঙচুর করবে? এর তো দরকার নেই।’

‘আছে। এত দিন ভুল করেছি। পাপ মোচন করতে হবে না!’

মানে, ক্ষমতার পালাবদলের পরই ছাত্রদল ক্যাম্পাস দখলে আসবে ভেবে নিজেরাই দল বদলে ছাত্রদল হয়ে গেছে। এই নিয়ে নিজেদের বৈঠকে কিছু দ্বিমত তৈরি হয়েছিল। যারা রাজি হয়নি ওদের এক কাপড়ে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এবং এর মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে সম্ভবত ছাত্ররাজনীতির পতনের শেষ পেরেকটি পড়ে। এর আগ পর্যন্ত বিষয়টা ছিল এ রকম যে সরকারে যে-ই থাকুক ক্যাম্পাস বা ছাত্ররাজনীতি চলবে তার নিয়মে। ব্যত্যয় ঘটে বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর। কিন্তু আগে থেকেই ক্যাম্পাস তাদের দখলে থাকায় সেটাকে খারাপ দেখায়নি। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে এসেও অনেক দিন সময় নিয়েছে ক্যাম্পাসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়। তা-ও কত কাঠখড় পুড়িয়ে। এবার প্রথম রাতেই। ছাত্ররাজনীতি মানে যে সরকারের সঙ্গে লড়াই, ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম—সেই ছবিটা সেই রাতে মুছে গেল পুরোপুরি।

তিনটি গল্প শোনালাম এটা বোঝার জন্য যে এখানে হলে চলে অস্ত্রবাজদের দৌরাত্ম্য, নেতার বাসায় লাইন দিয়ে হতে হয় শিক্ষক এবং ছাত্ররাজনীতি চলে সরকারের নিয়মে। তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হয়ে যায়নি, তবু এসব ছবি দেখে মনে হচ্ছিল পতনের যে পথে চলছে তাতে একদিন আসবে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মনে হবে সোনালি অতীত, বিব্রতকর বর্তমান এবং অন্ধকার ভবিষ্যৎ। শতবর্ষের আয়োজনে আবহসংগীত হিসেবে এই কথাগুলো ব্যবহার করলেই বোধ হয় সঠিক সুর বাজানো হবে।

আর তখনই মনটা এত খারাপ হয়! মনে পড়ে, এত কটুকথা বলছি যে দেশে বসে, যে সমাজে দাঁড়িয়ে, সেটা তো এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই তৈরি করে দেওয়া। যে যত কথাই বলুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে বাংলাদেশ এত দ্রুত বাংলাদেশ হয় না। তৈরি হয় না এই বাংলার মানুষের প্রগতির বোধ, সভ্যতার চিন্তা, মর্যাদার অধিকার।

পাকিস্তান হওয়ার পর বাঙালির যত রকমের অধিকার আন্দোলন তার প্রতিটিরই কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে যান, নানাজন নানাভাবে লিখবে; কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন কোনোটা থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদ পড়ছে না। স্বাধীনতার কথাও প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই বলেছে। স্বাধীনতার পতাকাও তারাই উড়িয়েছে। এসব চর্চিত বিষয় বলে খুব না যাই; কিন্তু আমাদের এই বাংলার যে বাঙালি মানস সেটাও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই তৈরি করে দেওয়া। সামন্ত প্রভু এবং প্রজাভিত্তিক যে মুসলমান সমাজ, সেখানে মধ্যবিত্তের উন্মেষই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে। কৃষক-শ্রমিকের ছেলে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পেয়েছে মর্যাদা আর পরিচয়ের জায়গা। তাদের প্রভাবে যে শ্রেণি তৈরি হয়েছিল এরাই আসলে বাংলাদেশ। সত্যি বললে আজকের দেশের যে রুচি আর চিন্তার মানস, সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকত্বেই তৈরি। এটা জীবন বদলানোর ঠিকানা দেখায়, সাংস্কৃতিক রূপরেখা শেখায়, প্রগতি-প্রতিবাদের বোধ জাগায়; এমনকি আজও, সাধারণ পরিবারের সাধারণ সন্তানের জীবন বদলের স্বপ্ন ঘুরপাক খায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে। প্রায় বিনা মূল্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা পেয়ে যাওয়ার সুযোগ পৃথিবীর আর কোথাও এমন অবারিত নয়, যখন কাছাকাছি মাপের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লাখ লাখ টাকা গুনতে হয়। পতিত সময়েও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপস করতে রাজি নয় এই বিশ্ববিদ্যালয়, যখন অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পোয়াবারো।

আর তখনই ক্ষীণ আশা দেখি। সোনালি কাঠামোটা তো আছেই। দরকার তাতে আধুনিক চিন্তার প্রয়োজনীয় প্রলেপ। হয়তো পরিবর্তিত বাস্তবতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যালেঞ্জ আছে, হয়তো বদলানো সমাজে সেই প্রতিবাদী-প্রতিরোধী চরিত্রের চাহিদা নেই; কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিচর্যা করলে এখনো অনেক কিছুই সম্ভব।

শুধু ভাবুন, এখানে একসঙ্গে আছে দেশের সেরা ৩৫-৪০ হাজার তরুণ। শিক্ষায় আর চিন্তায় এদের পথে রাখুন। ব্যস, বাংলাদেশ ঠিক পথেই থাকবে। যেমন ভাষা আন্দোলনের সময় ছিল, যেমন স্বাধীনতার সময় ছিল, যেমন নব্বইয়ের দশকে ছিল।

মোস্তফা মামুন

লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক

Leave a Comment