ঢাকার বাসে বেশি ভাড়া আদায় চলছেই

ঢাকার বাসে সিটিং সার্ভিসের নামে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করা বন্ধ হয়নি। অবশ্য যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়া দিতে সহজে রাজি হচ্ছেন না। এ নিয়ে বাসের চালক ও সহকারীদের সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত বচসা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটছে। শ্রমিকেরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে না পারলেও মালিকদের ঠিকই ‘সিটিং সার্ভিস’ ধরে টাকা বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে। প্রতিবাদে শ্রমিকেরা দুই দিন ধরে ঢাকার কয়েকটি রুটে কম সংখ্যায় বাস চালাচ্ছেন।
যেমন গতকাল বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুর এলাকা দিয়ে যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ ছিল। শ্রমিকদের একাংশ নিজেরা বাস চালায়নি। পাশাপাশি তাঁরা রাস্তায় নেমে বাস চলাচলে বাধাও দেন। পরে মালিক ও পুলিশের তৎপরতায় দুপুরের পর থেকে বাস চলাচল শুরু হয়। যদিও সংখ্যা ছিল কম। ঢাকার বিশৃঙ্খল বাস সেবার সুফলভোগী একটি গোষ্ঠী, যারা নেতৃত্বে রয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা বিআরটিএর পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্যোগ দরকার।



ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে আবদুল্লাহপুর রুটে চলাচলকারী প্রজাপতি পরিবহনের চালক মো. সুজন বলেন, সিটিং সার্ভিসের ভাড়া চাইলেই সব যাত্রী এককাট্টা হয়ে শার্টের কলার ধরে টানাটানি করেন। কিন্তু মালিককে টাকা দিতে হয় সিটিং সার্ভিস ধরেই। তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায় আমরা তিন দিন ধরে বাস চালানো বন্ধ রেখেছি।’ সরকার ৪ নভেম্বর থেকে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ানোর পর বাসভাড়া ২৭ শতাংশের মতো বাড়ানো হয়। তবে মালিকেরা বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ১০ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, ঢাকায় তিন দিনের মধ্যে সিটিং ও গেটলক সার্ভিস বন্ধ হবে। কিন্তু গতকাল ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাসশ্রমিক ও যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিটিং সার্ভিসের নামে মালিকেরা শ্রমিকদের বাড়তি ভাড়া আদায়ে বাধ্য করছেন। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সিটিং সার্ভিস বন্ধ করতে বললেই তো আর বন্ধ হয়ে যায় না। যারা বন্ধ করবে না, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিটিং সার্ভিস ‘আগের মতোই’
২০১৬ সালে ঢাকার জন্য করা সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার মানুষ বাস-মিনিবাসে যত যাতায়াত করে, তার ৪০ শতাংশই কম দূরত্বের পথে, তিন কিলোমিটারের মধ্যে। তবে বিভিন্ন রুটে বাসমালিকেরা বাসকে সিটিং ও গেটলক সার্ভিস নাম দিয়ে স্বল্প দূরত্বের ক্ষেত্রেও পুরো পথের ভাড়া আদায় করছিলেন। ধরা যাক, মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন থেকে একজন যাত্রী কাজীপাড়া যাবেন। মিনিবাসে তাঁর ভাড়া হওয়া উচিত ৮ টাকা। কিন্তু সিটিং সার্ভিসের নামে যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হয় মিরপুর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত দূরত্বের ২০ টাকা ভাড়া। সিটিং সার্ভিসের বাসে কত যাত্রী উঠল তা তদারকির জন্য পথে মালিকের প্রতিনিধি থাকেন, যাঁদের বলা হয় ‘চেকার’। তাঁরা বাস থামিয়ে কত যাত্রী উঠেছে, তা নথিতে লিখে দেন। এই নথিকে বলে ‘ওয়েবিল’। শ্রমিকেরা জানান, ওয়েবিলে যদি ৩০ জন যাত্রীর কথা লেখা হয়, তাহলে মালিককে সমসংখ্যক যাত্রীর বিপরীতে পুরো পথের ভাড়া বুঝিয়ে দিতে হবে। কোনো যাত্রী স্বল্প দূরত্বে নেমে কম ভাড়া দিলেন কি না, তা বিবেচনায় নেওয়া হয় না।

সরেজমিনে ঘুরে গতকাল দেখা যায়, মিরপুর হয়ে চলাচলকারী প্রায় সব পরিবহনের বাসে ওয়েবিল ব্যবস্থা রয়ে গেছে। ঢাকার মৎস্য ভবন ও হাইকোর্ট মোড় এলাকায় দাঁড়িয়ে বাসশ্রমিক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই পথ হয়ে চলাচলকারী বাসেও সিটিং সার্ভিস ব্যবস্থাই বহাল রয়েছে। স্বাধীন এক্সপ্রেস নামের একটি পরিবহনের বাসে আগারগাঁও থেকে মৎস্য ভবনে নেমে যাওয়া গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মচারী মোহাম্মদ হোসেন বলেন, মৎস্য ভবনে নামলেও তাঁর কাছ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে।

‘আমরা মাইর খাই’
যাত্রীরা এবার আর সহজে বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়টি মেনে নিচ্ছেন না। ‘ট্রাফিক অ্যালার্ট’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে বাসে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার চেষ্টার কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন যাত্রীরা। যাত্রীদের একজন সাদ আহমেদ লিখেছেন, বিশ্বরোড থেকে মিরপুর ১ নম্বর সেকশন যেতে তাঁর কাছে ভাড়া চাওয়া হয় ৪০ টাকা। তিনি চালকের সহকারীকে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে ভ্রাম্যমাণ আদালত ডাকার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘খেলা হবে আজকে’। তখন তাঁর কাছ থেকে ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী ২৩ টাকা নেওয়া হয়।

তবে সব যাত্রী এমন সাহসী নন। মিরপুর থেকে কারওয়ান বাজারে নিয়মিত চলাচলকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, ‘ভাড়া নিয়ে তর্ক করলে বাসশ্রমিকেরা গালি দেয়। আমাদের এতই দুর্ভাগ্য যে ভাড়া নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে মারামারি করতে হয়।’
ঢাকার গাবতলী থেকে ডেমরা স্টাফকোয়ার্টার রুটে চলাচলকারী ওয়াসিম পরিবহনের চালক মো. হৃদয় গতকাল পল্লবীর কালশী সড়কে চায়ের দোকানে বসে ছিলেন। তিনি বলেন, গত সোমবার এক যাত্রীর কাছে সিটিং সার্ভিসের ভাড়া চাইতে গিয়ে মারধরের শিকার হতে হয়েছে। যাত্রীরা তালিকার বাইরে ভাড়া দিতে রাজি নন।

হৃদয় আরও বলেন, ‘আমরা মাইর খাই। মালিক টাকা বুঝে নেন। তাই বাসই চালাচ্ছি না।’সড়ক পরিবহন আইন ও রুট পারমিটের ক্ষেত্রে সিটিং সার্ভিস বলে কিছু নেই। বাসমালিকেরা কেন ‘সিটিং সার্ভিসের’ ভাড়া আদায় করছেন, তা জানতে চাইলে মো. শফিক নামের এক বাসমালিক বলেন, সিটিং সার্ভিস ছাড়া রাস্তায় বাস চালানো সম্ভব নয়। তাতে লোকসান হয়।

‘এটা সরকারের গায়ে লাগা উচিত’
ঢাকায় ১২৮টি রুটে সাত হাজার বাস চালানোর অনুমতি আছে। সর্বশেষ যে বাসভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে একটি বাস গড়ে ৯৫ শতাংশ যাত্রী নিয়ে চলবে বলে ধরা হয়েছে। বাসের অর্থনৈতিক মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ১০ বছর। যদিও ঢাকায় চলা বেশির ভাগ বাস পুরোনো ও লক্কড়ঝক্কড়। এমনকি বাসগুলো রং করারও প্রয়োজন বোধ করেন না মালিকেরা। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বাস রং করার তাগিদ দিয়েছিলেন। তাতে কাজ হয়নি।এর আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক বাস চালানোর ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনা ও নতুন চার হাজার বাস নামানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যদিও অগ্রগতি সামান্য। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ঢাকার বিশৃঙ্খল বাসসেবার সুফলভোগী একটি গোষ্ঠী, যারা নেতৃত্বে রয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা বিআরটিএর পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্যোগ দরকার। তিনি বলেন, এই সরকারের অনেক অর্থনৈতিক অর্জন আছে। তবে যখন কেউ বিদেশ থেকে এসে ঢাকার গণপরিবহনের মান দেখে, তখন সেই অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এটা সরকারের গায়ে লাগা উচিত।

Leave a Comment