যাত্রীসেবার মান বাড়াতে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২২০০ হর্স পাওয়ারের ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনার চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ইতোমধ্যে ইঞ্জিনগুলো দেশে পৌঁছেছে। পরীক্ষামূলকভাবে এর একটির ব্যবহারও শুরু হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিন দেয়নি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ২২০০ হর্স পাওয়ার ইঞ্জিনের জন্য ৩০০০ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর সরবরাহের কথা থাকলেও দেওয়া হয়েছে ২২০০ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর।
এদিকে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ না করলেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ৬৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগ তোলায় এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থ আটকে দেওয়ায় প্রকল্প পরিচালক নূর আহমেদ হোসেনকে গত ৩১ মার্চ তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক হিসেবে তারই এক জুনিয়রের অধীনে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নূর আহমেদের স্থলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে রেলওয়ের অপর এক প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুরকে। তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৫০টি রেলকোচ ক্রয়ে হাসান মনসুরের বিরুদ্ধে ‘ক্রয় প্রস্তাবে বিধিবিধান যথাযথভাবে মানা হয়নি’ বলে অভিযোগ করে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখারও নির্দেশ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক- এডিবি’র অর্থায়নে প্রায় ৩২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি রেল ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনার জন্য ২০১৮ সালের ১৭ মে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চুক্তি অনুযায়ী ১০টি মিটার গেজ ইঞ্জিন সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তির পর অগ্রিম পরিশোধ করা হয় ২৫ শতাংশ অর্থ। ইঞ্জিনগুলো দেশে আনার পর ৬৫ শতাংশ এবং গুণগত মান যাচাই শেষে বাকি ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের কথা।
কিন্তু দেশে আসার পর ইঞ্জিনগুলো নিম্নমানের বলে ধরা পড়ে। এ অবস্থায় সাবেক প্রকল্প পরিচালক নূর আহমেদ হোসেন চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ অর্থ আটকে দেন। ওই অর্থ ছাড় না দেওয়ার জন্য সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ও এডিবিকে চিঠি দেন। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ লিখিতভাবেও উপস্থাপন করেন তিনি।
নূর আহমেদের অভিযোগের সূত্র ধরে গত বছরের ২৪ নভেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান করা হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও ভূমি) ফারুকুজ্জামানকে। কমিটি গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দফতরে জমা দেয়। এর একটি অনুলিপি গণমাধ্যমের কাছে এসেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী লোকোমোটিভ সরবরাহ না করায় হুন্দাইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে কমিটি। এছাড়া প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশনের দায়িত্বে থাকা সিসিআইসি সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের বিরুদ্ধেও দায়িত্বে অবহেলার জন্য ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, হুন্দাই অল্টারনেটরের মডেল টিএ৯-১২সিএ৯এসই সরবরাহ করেছে, কিন্তু চুক্তিতে উল্লেখ ছিল টিএ১২-সিএ৯ ইঞ্জিনের কথা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দুই মডেলের ইঞ্জিনের শক্তি উৎপাদনের সামর্থ্যে পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের সব রেলপথকে ডুয়েল গেজ লাইনে রূপান্তরিত করা। সরকারপ্রধানও একাধিকবার রেলওয়েকে নির্দেশ দিয়েছিল যে, এমন লোকোমোটিভ কিনতে যেগুলোতে কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন এনে মিটার গেজ ও ব্রড গেজ দুই ট্র্যাকেই চালানো যাবে। কিন্তু টিএ৯-১২সিএ৯এসই অল্টারনেটর থাকার কারণে এ ইঞ্জিনগুলো ব্রড গেজে চলবে না বলে জানান তারা।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সরবরাহ করা ইঞ্জিনগুলোর চারটি মূল কারিগরি উপাদান- ইঞ্জিন, অল্টারনেটর, কমপ্রেসর ও ট্র্যাকশন মোটর চুক্তিতে উল্লেখ করা বর্ণনার সঙ্গে মিল নেই।
এদিকে, প্রকল্পের নতুন পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর গত ১৭ মে বলেন, ‘৬৫ শতাংশ অর্থ হুন্দাই রোটেম কোম্পানিকে দেওয়া হয়নি। কথাবার্তা চলছে। আগামী জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ১৯৫২ সাল থেকে একই মানের ইঞ্জিন দিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেন পরিচালিত হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে না। এখন যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। সরবরাহ করা ১০টি ইঞ্জিনের একটি কম্পোনেন্টের আকারে ভুল করা হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা যেত বা কম্পোনেন্ট পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া যেত। এখন অবস্থা এমন যে আমি প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব নেওয়ার পর এ নিয়ে বিপাকে আছি। তবে ইঞ্জিনগুলো ব্যবহার করে কনটেইনার ও মালগাড়ি চালানো হচ্ছে পরীক্ষামূলকভাবে।
‘চুক্তি অনুযায়ী এখনও যেসব যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়নি সেগুলো পূরণের লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। অলটারনেটরের সংযোগের মাধ্যমে ইঞ্জিনগুলো যথাযথ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
বন্ধ এডিবির অর্থছাড়
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক- এডিবি এ প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করা হয়নি বলে গত নয় মাস ধরে এর মূল্যও পরিশোধ করা হয়নি। জানা গেছে, দুর্নীতি ও অনিয়ম হওয়ায় ঋণের অর্থছাড় বন্ধ করে দিয়েছে এডিবি। সংস্থাটির ঋণ চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩০ জুন।