টার্নিং পয়েন্ট

১.
-“ধুরো মামা! কিল্লায় যে মেহেজাবীন এর লগে হুদাই ঝামেলা করছিলাম। আর মাইয়াডাও ব্রেক আপ কইরা দিল! সেই ৫ বছর থাইকা মোর আর কোনো প্রেমই টিকতেছে না। এর পর কতগুলো মাইয়ার লগে প্রেম হইলো হিসেব ছাড়া। লাস্ট একবছরে ১৫+ প্রেম হইছে রে। একটাও টিকে নাই। আইজ আবার লিসা ব্রেক আপ করছে। মাথাটা কেমনে ঠিক থাকে তুই ক দেখি?

ছেলেটার এহেন কথাবার্তায় যখন সবাই তার দিকে পাশ ফিরে তাকাচ্ছিল, তখনই বোধ হয় ছেলেটার একটু টনক নড়লো। সে ধপাস করে আমাদের সামনের সীটে আয়াজের মুখোমুখি হয়ে বসলো। গলা নামিয়ে এবার বেশ ভদ্র সুরে বলতে শুরু করলো,

-এই যে এত প্রেম করলাম। মেহেজাবীনের মতো কাউকেই পাইনি রে। মেয়েটা এত ভালবাসতে জানতো, তোকে কি আর বলব! ওর মতো এত নিঃস্বার্থভাবে আর কেউ আমাকে ভালবাসে নি, বুঝলি? বাট আমি ওর মূল্যটা বুঝিনাই মাম্মা। কি ভুলটাই না করেছি। যাগ্গে, আরও অনেক কথা আছে। ঢাকায় গিয়ে সব বলবনি, ওকে? এখন রাখলাম।

ছেলেটির কথায় আমি বেশ ভড়কে গিয়েছিলাম। প্লেবয় টাইপের এই ছেলেটি একটু আগে ফোনে যে মেহেজাবীনের কথা বললো, সেই মেহেজাবীন আর কেউ নয়। আমি নিজেই! কিন্তু এখন আমার আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢাকা। এজন্যই সে আমাকে চিনতে পারেনি। আমি খুব অস্বস্তিবোধ করতে লাগলাম।

২.
আয়াজ আমার স্বামী। ২বছর হতে চললো আমাদের বিয়ের। সে ভীষণ বই পাগল! বইয়ের পোকা বললেও ভুল হবে না। খুব নম্র-ভদ্র, শান্ত, ধৈর্যশীল একজন মানুষ। প্রচন্ড ভালবাসতে পারে এই ভদ্রলোক। বিয়ের দুই বছরে একদিনও সে আমার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করে নি।
তার একটাই বদভ্যাস, সে বই পেলে সব ভুলে যায়। একটা মানুষ এত পড়তে পারে!

ওর লাইব্রেরি রুমে প্রথম দিন ঢুকেই আমি অবাক বনে গিয়েছিলাম। বিশাল একটি রুমের মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত একেকটা কি আকর্ষণীয় বুকশেলফ। কম করে পনের হাজার বই আছে তার সংগ্রহে! তখনই বুঝতে পেরেছি আমার মত পড়ুয়ার চার আনাও দাম নেই তার কাছে। আর বিয়ের আগে আমিই বলেছিলাম বই পড়ার অভ্যাস আছে কি-না! সে মৃদ্যু হেসে জবাব দিয়েছিল, “আছে টুকটাক”। এই টুকটাক এর মানে এখন বুঝতে পারছি!

বুকশেলফ গুলোর ফাঁকে ফাঁকে আবার মানিপ্লান্ট, বনসাই, ক্যাকটাস এর কত রকমের চারা! রুমটি সবুজ গাছে খুবই নান্দনিকভাবে সাজানো। ইজি চেয়ার, সোফা, দোলনা থেকে শুরু করে বিছানা-বালিশও আছে। সবই আয়েশ করে বই পড়ার জন্য। এই রুমে আসলে যে কারোরই মন আপনা আপনিই ভালো হয়ে যাবে। রুমটা এতই রুচিশীলভাবে সাজিয়েছে আমার আয়াজ।

যদিও আমি বদমেজাজি। অল্পতেই রেগে যাই আবার অল্পতেই রাগ কমেও যায়। ভালো রাঁধতে পারি না। এরম ছোটখাট বাট মারাত্মক দোষ আমার আছে। কিন্তু
আমার কোনো বিষয় নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই। রান্না খারাপ হলেও চুপচাপ খেয়ে যাবে, ভাল হলেও তেমন। কোনোদিন যদি মজা করে বলি, “আজ রান্না করতে মন চায় নি, তাই কিছুই রান্না করি নি।” সে প্রথমেই বলবে, ” আমার কোনো সমস্যা নেই কিন্তু তুমি কী খাবে? বাইরে গিয়ে নিয়ে আসবো কিছু?” তারপর বলবে, “আমি তো সব মেনে নিতে পারি কিন্তু সারারাত না খেয়ে থাকলে তুমি তো সিক হয়ে যাবা! ফ্রিজে ফল আছে। কেটে আনি?”

আমি কিছু বলি না। ওর দিকে চেয়ে থাকি আর মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। আনন্দে আমার চোখে পানি চলে আসে। আমার চোখে হঠাৎ পানি দেখে সে ভীত হয়। চটজলদি আমার কাছে এসে বসে। যত্ন করে চোখ মুছে দিয়ে বলে, “মেহু, তোমার কী হয়েছে? মন খারাপ? বাবা-মা এর কথা মনে পড়ছে? আমার কোনো আচরণে কষ্ট পেয়েছো?”

আমি ওর কাঁধে মাথা রাখি। খুশিয়াল গলায় কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলি, “তুমি এত ভাল কেন? আমি কী এত ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য?”

শাহাদত আঙ্গুল দিয়ে সে আমার ঠোঁট আলতো ছুঁয়ে বলে,”একদম চুপ! আমার বউয়ের যোগ্যতা নিয়ে কোনো কথা হবে না। সে এত ছেলেমানুষি করে জন্যই আমি ভাল থাকি। আমার এরম একটা পাগলি বউয়ের ই তো দরকার ছিল। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ্ আমার ইচ্ছেটা পূরণ করেছেন। এতেই আমি খুশি।”
এই মানুষটাকে ভাল না বেসে কীভাবে থাকা যায় আমার জানা নেই। আমি আয়াজকে প্রচন্ড ভালবাসি আর সেও ব্যতিক্রম নয়।

৩.
ট্রেনের এই ছেলেটির নাম আরাফ। মাত্র ছয় মাসের প্রেম ছিল আমাদের। সে আমার প্রথম ভালবাসা ছিল। আমি তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম। আমি তাকে সব স্বাধীনতা দিয়েছিলাম, কিন্তু সে আমার সব স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল। নির্দিষ্ট একটা গন্ডির ভিতর আমাকে রাখতে চাইত। কষ্ট হলেও আমি মেনে নিতাম।

ভালই চলছিল সব কিছু। হঠাৎ সে আমার কাছে এক্সট্রা একটি ডিমান্ড করে। ভয়াবহ অশ্লীলতায় পূর্ণ! আমি তার কথা শুনে যেন মাটিতে তলিয়ে যাচ্ছি। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছিল না। নিজেকেই নিজে বললাম, ” হাউ ইজ ইট পসিবল? আরাফ এত বাজে?” সে আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিল। আমাকে কিছু সময় দিল সিদ্ধান্ত নিতে। আমি যদি তার এই প্রস্তাবে রাজি না হই, তাহলে রিলেশনটা রাখা তার জন্য আর পসিবলই না।

মানতে পারছিলাম না বিষয়টা আবার তাকেও ছাড়তে পারছিলাম। কী করবো না করবো কিচ্ছু ভেবে না পেয়ে সালাতে দাড়ালাম। কারণ আমি কুরআনে পড়েছিলাম আল্লাহ্ বলেছেন, “তোমরা সালাত ও ধৈর্যের মাধ্যমে আমার সাহায্য চাও।”[২:৪৫]
আমি কেঁদে কেঁদে সেদিন আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছি। উত্তম ফয়সালা এবং আমার জন্য কল্যাণকর জীবনসঙ্গী চেয়েছি। আল্লাহ আমার দু’টি ইচ্ছেই পূরণ করেছেন আলহামদুলিল্লাহ।

সেদিনই আমি হারাম সম্পর্কের ইতি টানি। আর তার কয়েক বছর পরে আল্লাহ্ আমার আরেকটি ইচ্ছে পূরণ করেন। আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে আয়াজকে পাই। আলহামদুলিল্লাহ!

৪.
রংপুর টু ঢাকাগামী ট্রেনের পুরোটা সময়, আয়াজের সাথে আমি কোনো কথা বলি নি। আশ্চর্যের বিষয়, সেও নিজের মতো করে বই পড়েই যাচ্ছিল, আমার খিদে পেয়েছে কি না এটাও জিজ্ঞেস করে নি। এটা আজই প্রথম।
আরাফও কোনো কথা বলে নি। নিজের মতো করে নিজেকে ফোনে ব্যস্ত রেখেছে।
আমি জানালা থেকে মুখ তুলে আয়াজকে কিছু বলতে যাব, তখনই আরাফের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়। আমি চোখ নামিয়ে নিই। আমার ভ্রুও ঢাকা ছিল, শুধু চোখ বাইরে। আয়াজকে আর কিছুই বললাম না।

স্টেশনে প্রায় চলেই এসেছি। সেই মুহূর্তে আরাফ কৌতূহল দমন না করতে পেরে হোক, আর যে কারণেই হোক। সে আয়াজের সাথে কথা বলা শুরু করলো।

-ভাইয়া, একটু পর আমরা নেমেই যাব। কিন্তু এখনও পরিচিতই হলাম না! আমি আরাফ, একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে এবারই অনার্স কমপ্লিট করলাম। আপনাদের পরিচয় কি দেয়া যাবে? আই গেজ, আপনারা হাজবেন্ড-ওয়াইফ!
-জ্বী ভাইয়া, আপনি ঠিকই ধরেছেন। ২ বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমি আয়াজ আর ও?

আমি গোপনে আয়াজের হাত চেপে ধরলাম। চোখের ইশারায় বারণ করলাম ওকে কিছু না জানাতে। এরই মাঝে ট্রেন থেমে গেছে। আমরা নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
আমি আয়াজকে রেখেই হাঁটা দিচ্ছিলাম। আরাফের সাথে নতুন করে পরিচিত হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। শুনতে পেলাম

আয়াজ বললো, “ও মেহু ওরফে মেহেজাবীন। আপনি ঠিক যার কথা মনে করে আফসোস করেছিলেন শুরুতে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া, আপনার ঐ রকমের সিদ্ধান্তের জন্য। যা পাঁচ বছর আগে আপনি নিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে আপনাদের বিচ্ছেদ আর আমার মেহুকে পাওয়া। আসি ভাই, ভাল থাকুন। আসসালামু আলাইকুম।

এতটুকু বলেই আয়াজ দ্রুত আমার কাছে চলে এলো। ততক্ষণে আমি থমকে দাঁড়িয়েছি। আরাফ অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নেমে যাবার কথাও বোধ হয় ভুলে গেছে। আয়াজ আমার দিকে ফিরে বললো, “আমি আর খিদে চেপে রাখতে পারছি না। চলো আগে খাবো।” সে আমার হাত ধরে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। আমি একবার পিছনে ফিরে দেখলাম, জানালার ফাঁক দিয়ে আরাফ আমাদের চলে যাওয়া দেখছে।

Writer: Mahazabin Sharmin Priya

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *