জমার টাকা ওঠাতেই বেপরোয়া চালকেরা

দিন শেষে মালিককে দুই হাজার টাকা জমা হিসেবে দিতেই হবে। এরপর জ্বালানি বাবদ ব্যয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। টোল, চাঁদা, পথের খরচ ও ‘ঘুষ’ আরও মোট দেড় হাজার টাকা। এই সাত হাজার টাকার ব্যবস্থা করার পর যা থাকে, তা ভাগাভাগি করে নেন চালক ও তাঁর সহকারী।কালিয়াকৈরের চন্দ্রা থেকে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী ঠিকানা পরিবহনের চালক সিরাজুল ইসলাম এ হিসাব দিয়ে বলেন, দিনে তিনটি ট্রিপ (যাওয়া-আসা) দিতে পারলে তিনি হাজারখানেক ও সহকারী ছয় শর মতো টাকা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারেন। এ জন্য বাস চালাতে হয় ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত।চালক সিরাজুল আরও বলেন, মালিকের জমা ওঠাতেই প্রতিযোগিতা করে বাস চালাতে হয়। পথের অনেক খরচ আছে। এ ছাড়া তাঁদের উপায় নেই। বাসে বাসে প্রতিযোগিতা, একটিকে অপরটির ধাক্কা ও ঘষা দেওয়ার কারণও এটি।

সিরাজুলের মতো ১৫ জন চালক ও ১০ জন চালকের সহকারীর (হেলপার) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেপরোয়া বাস চালানোর বড় কারণ মালিকের জমা ওঠানোর তাগিদ, মাদকাসক্তি এবং অদক্ষতা ও ট্রাফিক আইন সম্পর্কে না জানা। দুর্ঘটনা ঘটার পর পার পেয়ে যাওয়ায় চালকদের অনেকে কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না। এ বাইরে চালকেরা পথচারীর অসতর্কতা, রাস্তার পাশে দোকানপাট গড়ে ওঠা এবং রিকশা, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলচালকদের হুটহাট লেন পরিবর্তনকে দুর্ঘটনার কারণ বলে উল্লেখ করেন।এবার দেখা যাক এসব বিষয়ে আইনে কী বলা আছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী, চালককে নিয়োগপত্র দিয়ে বাস চালাতে হবে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে মালিক সমিতি ঘোষণা দেয়, পরদিন থেকে চুক্তিতে বাস চালানো হবে না। যদিও তা বাস্তবায়িত হয়নি। চালকদের মাদকাসক্তি পরীক্ষার বড় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চালকেরাই বলছেন, ঘুষ দিলে দক্ষতা ছাড়াই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়। এক চালক নিজেই স্বীকার করেন, তিনি ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স পেয়েছেন।বাস চালানো ও চালকদের এই বিষয়গুলো আবার সামনে এসেছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। গত বুধবার ঢাকার নটর ডেম কলেজের এক ছাত্রের মৃত্যুর পর কয়েক দিন ধরে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এর আগে ২০১৮ সালে তাঁরা ৯ দিন ঢাকার রাস্তায় আন্দোলন করেছিলেন।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত কমিটি ৩০টি নির্দেশনা জারি করে। যদিও তার বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। নতুন সড়ক আইন হয়েছে। কিন্তু সেই আইন বাস্তবায়নেও অনেক ঘাটতি। আইনটির বিধিমালা এখনো তৈরি করতে পারেনি সরকার। বাসের প্রতিযোগিতা বন্ধে একটি রুটে একটি কোম্পানির অধীনে বাস চালানোর উদ্যোগও এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।এদিকে চালকেরা যেসব অভিযোগ করেছেন, তা কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই মেনে নিয়েছেন মালিকদের সংগঠন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। গতকাল শনিবার তিনি বলেন, বাসচালকদের অভিযোগ অনেকাংশে ঠিক। দৈনিক জমার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার কারণে চালকেরা দীর্ঘ সময় ধরে এবং বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। কেউ কেউ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালান। এতে দুর্ঘটনা ঘটে। সড়কে চাঁদাবাজি ও হয়রানির অভিযোগ নিয়ে তিনি বলেন, ‘মালিক সমিতি থেকে দিনে মাত্র ৩০ টাকা নেওয়া হয়। বাকি টাকা কারা নেয়, তা আপনারাও জানেন।’

চালকেরা যা বললেন
চালক সিরাজুলের সঙ্গে গত শুক্রবার দেখা হয় গাবতলী বাস টার্মিনালে। তিনি বাস থামিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এই চালক বলেন, মাসে ১৫টির মতো ট্রিপ দেওয়া যায়। এতে পথের খরচ বাদে আয় হয় ১৫ হাজার টাকার মতো। তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালান।সড়কে চলাচলকালে জরিমানার শিকার হলে চালক ও তাঁর সহকারীর খরচ বেড়ে যায়। এই খরচ পোষাতে তাঁরা আরও বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালানো ও যাত্রী নেওয়া শুরু করেন বলে অভিযোগ। চালকেরা বলছেন, নতুন আইনে জরিমানার পরিমাণ বেশি। তাঁরা জরিমানা করতে গেলে পুলিশকে কিছু টাকা দিয়ে ‘ম্যানেজ’ করেন।যেমন ঢাকার আজিমপুর থেকে গাজীপুর রুটে চলাচলকারী ভিআইপি পরিবহনের এক চালক বলেন, ‘সিটিং সার্ভিস বন্ধ করার পর আমরা গাড়ির দরজা খোলা রাখি। গত বৃহস্পতিবার দরজা খোলা রাখার দায়ে আমাকে জরিমানা করতে যান এক ট্রাফিক সার্জেন্ট। ৫০০ টাকা দেওয়ার পর ছেড়ে দিয়েছেন।’

ঢাকার আজিমপুর-কুড়িল বিশ্বরোড রুটে চলাচলকারী একটি পরিবহনের চালক আবুল হোসেন বলেন, পুলিশকে প্রতি সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নামে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি চলে।জরিমানার বদলে টাকা নিয়ে বাস ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ সঠিক নয়। প্রতি সপ্তাহে বাস কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই।অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পণ্যবাহী ট্রাক, মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ির চালকদের লাইসেন্স ও অন্যান্য নথি তদারকির ক্ষেত্রে পুলিশের যত আগ্রহ, তার সিকি ভাগও নেই বাসের ক্ষেত্রে।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে চালকেরা মাদকাসক্তি ও লাইসেন্স ছাড়া বাস চালানো নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে আবদুল্লাহপুর রুটে চলাচলকারী আলিফ পরিবহনের চালক নাইম হাসান বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, মালিকেরা লাইসেন্সধারী দক্ষ চালকের হাতে বাস দেন। চালক পথে বাস সহকারীর হাতে দিয়ে নেমে যান। সহকারী বাস চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটান।কেন চালকেরা এটা করেন, তার দুই কারণ জানা যায়। প্রথমত, অনেকে দীর্ঘ সময় ধরে বাস চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে নেমে যান। তাঁরা বলেন, দিনে টানা ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা বাস চালানো অত্যন্ত কঠিন। এই কাজটি করতে তাঁদের বাধ্য করে গণপরিবহনে চুক্তি ব্যবস্থা। দ্বিতীয় কারণ, অনেকে মাদক নিতে যাওয়া।জিরানী বাজার থেকে মতিঝিল রুটে চলা ওয়েলকাম পরিবহনের চালক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, চালকদের একটা বড় অংশ নেশাগ্রস্ত। তাঁদের পক্ষে তো আর ভালোভাবে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়।

৮৪% দুর্ঘটনার কারণ অতিরিক্ত গতি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) গবেষণার তথ্য বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে গত জুন পর্যন্ত সারা দেশে ৩ হাজার ৬৪টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩ হাজার ৫৫৮ জন। আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৪৫০ জন। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, ৮৪ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি।চালকের মাদকাসক্তি দুর্ঘটনার দ্বিতীয় প্রধান কারণ। এআরআই বলছে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে দুর্ঘটনায় ১২ থেকে ১৪ শতাংশ ক্ষেত্রে চালককে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পাওয়া যেত। সে হার গত দেড় বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশে।এআরআইয়ের পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, বেপরোয়া গতি, দীর্ঘ সময় ধরে ক্লান্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো এবং নেশাগ্রস্ত চালকের কারণে সড়কে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, চালকদের প্রশিক্ষণ নেই। টাকার বিনিময়ে যে কেউ গাড়ি চালানোরা লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছেন। এসব অনিয়ম বন্ধ ও সড়ক আইন বাস্তবায়িত না হলে সড়কে দুর্ঘটনা কমবে না।

টাকা ‘দিলেই’ লাইসেন্স
চালকদের সঙ্গে কথা বলে লাইসেন্স-সংক্রান্ত দুটি অভিযোগ পাওয়া যায়। একটি হলো, লাইসেন্সধারী চালকের চেয়ে যানবাহনের সংখ্যা বেশি। এ কারণে মালিকেরা লাইসেন্সহীন চালকদের হাতেও বাস তুলে দেন। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৪৫ লাখের বেশি। কিন্তু চালকের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ ৭৫ হাজার। পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা বলছেন, কর্মঘণ্টা মানলে একটি ট্রাক বা বাসে তিনজন চালক দরকার। সংকটের কারণে গাড়ি চালাচ্ছেন অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকেরা।

]
দ্বিতীয় অভিযোগ হলো, দালাল ধরে পরীক্ষা ও যোগ্যতা ছাড়াই লাইসেন্স পাওয়া যায়। অবশ্য এই অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক এবং মুখপাত্র শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেওয়ান পরিবহনের এক চালক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দালাল ধরে লাইসেন্স করেছি। টাকা খরচ হয়েছে ১০ হাজার। অথচ বিআরটিএতে মাত্র ১ হাজার ৬৭৯ টাকা জমা দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘টাকা দিলে অন্ধ ব্যক্তির নামেও লাইসেন্স নেওয়া সম্ভব।’

Leave a Comment