চন্দ্রঘোনায় স্বাস্থ্যের আলো জ্বলেছিল ১৯০৭ সালে

১১৪ বছর ধরে মানুষকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে খ্রিষ্টিয়ান হাসপাতাল চন্দ্রঘোনা। খ্রিষ্টিয়ান মিশনারিদের মাধ্যমে পরিচালিত হলেও হাসপাতালটিকে অনেকটাই নিজেদের মনে করেন স্থানীয় হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই। সমতলের ও পাহাড়ের মানুষ, বাঙালি ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এখানে সেবা পেয়ে আসছেন। নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দেওয়ার কারণে এই হাসপাতালের প্রতি মানুষের অগাধ আস্থা।কর্ণফুলী নদীর তীরে চন্দ্রঘোনা সমতল ও পাহাড়ের মানুষের যোগাযোগের কেন্দ্রস্থল। সেখানে জঙ্গল পরিষ্কার করে ১৯০৭ সালে একটি ডিসপেনসারি তৈরি হয়। দ্রুতই ডিসপেনসারিকে অস্থায়ী হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়।

ওয়ার্ড তৈরি করে ৩২ জন রোগী রাখারও ব্যবস্থা হয়। এক বছর পর ১০০ শয্যার একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালের চেহারা পায় এটি। নাম খ্রিষ্টিয়ান হাসপাতাল চন্দ্রঘোনা। এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন ডা. জি ও টেইলর। এই দীর্ঘ সময়ে পাঁচজন বিদেশি ও পাঁচজন দেশি চিকিৎসক হাসপাতালের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলেন, হাসপাতালটি গড়ে ওঠার সময় ওই এলাকায় ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, টাইফয়েড ও কলেরার প্রকোপ অনেক বেশি ছিল। হাসপাতাল চালানোর মতো প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী পাওয়া ছিল কঠিন। তবে হাসপাতাল হওয়াতে মানুষের উপকার হয়েছিল, বিশেষ করে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের মানুষের। এই হাসপাতালের মাধ্যমে এই অঞ্চলে প্রথম কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা শুরু হয়। এই হাসপাতালই প্রথম নার্সিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। অনেকে এগুলোকে ঐতিহাসিক উদ্যোগ বলেই মনে করেন।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখন তাদের প্রধান কার্যক্রম চারটি। এগুলো হচ্ছে ১০০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল পরিচালনা, ৬০ শয্যার কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিচালনা, নার্স ও মিডওয়াইফ তৈরি করা এবং সামাজিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা।
ছোট প্রতিষ্ঠান হয়েও স্থানীয়ভাবে এবং কিছু ক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে বড় অবদান আছে খ্রিষ্টিয়ান হাসপাতাল চন্দ্রঘোনার। এখন সারা দেশের মতো চন্দ্রঘোনা এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল–ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। খ্রিষ্টিয়ান হাসপাতাল চন্দ্রঘোনাতে যন্ত্রপাতির ঘাটতির কথা বলেছেন কেউ কেই। এরপরও এই হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা এখনো অটুট দেখা গেছে। সরকারি–বেসরকারি চারটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা এই প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আসেন কমিউনিটি মেডিসিন কোর্সের শিক্ষা নিতে।

১০৮ বছরের কুষ্ঠ কেন্দ্র

৬০ শয্যার কুষ্ঠ কেন্দ্রটি তৈরি হয় ১৯১৩ সালে। এটি ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন কুষ্ঠ হাসপাতাল। বর্তমানে এটি বৃহত্তর চট্টগ্রামের জটিল ও প্রতিবন্ধী কুষ্ঠরোগীদের একমাত্র রেফারেল হাসপাতাল। রোগনির্ণয়, চিকিৎসা, খাবার ও প্রতিবন্ধী রোগীদের নানা উপকরণ এখানে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়।কুষ্ঠ চিকিৎসা ছাড়াও কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। চট্টগ্রাম শহর, পটিয়া, ফেনী, কক্সবাজারের মালুমঘাট, বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলায় ক্লিনিক তৈরি করে রোগী শনাক্ত এবং মানুষকে সচেতন করার কর্মসূচি ছিল তাদের।১৮ ডিসেম্বর সকালে কুষ্ঠ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, তিনজন কুষ্ঠরোগী রোদ পোহাচ্ছেন। কেন্দ্রের অধিকাংশ শয্যা শূন্য। কর্মকর্তারা জানালেন, দেশে কুষ্ঠরোগের প্রকোপ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে রোগীর চাপও কমেছে।

কেন্দ্রের সঙ্গে একটি ছোট জুতার কারখানা আছে। কিছু প্রতিবন্ধী রোগীর জন্য বিশেষ উপাদানের ও বিশেষ ধরনের জুতা এখানেই তৈরি হয়। বাইরের কুষ্ঠরোগী এবং অন্য কুষ্ঠ প্রতিষ্ঠানও এখান থেকে জুতা তৈরি করে নেয়।রোগীদের ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থাও আছে। ১৯৬৯ সালে এখানেই ফিজিওথেরাপির কাজ শুরু করেছিলেন সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (সিআরপি) বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি অ্যান টেইলর।

১৯৩১ সালে তৈরি হয় নার্সিং ইনস্টিটিউট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল) চিকিৎসায় নার্সদের ভূমিকা ও অভাব বিশ্বব্যাপী প্রবলভাবে অনুভূত হয়। সেই সময় এ অঞ্চলের নারীরা নার্সিং পেশায় আসতে চাইতেন না। পেশা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার ঘটতি ছিল, অনেকে কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব আছে বলে মনে করতেন। সেই সময় ১৯৩১ সালে খ্রিষ্টিয়ান হাসপাতাল চন্দ্রঘোনা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে নার্সিং ইনস্টিটিউট। লেডি মিস তিসমিসের পরিচালনায় এই ইনস্টিটিউটে শুরুর দিকে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকজন পুরুষ সদস্য যোগ দিয়েছিলেন।ধীরে ধীরে ইনস্টিটিউটকে বড় করার চেষ্টা করেছে কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে এখানে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি এবং ১৮ মাস মেয়াদি জুনিয়র মিড ওয়াইফারি কোর্স চালু আছে। প্রতিবছর এখান থেকে ১০০ জন নার্স ও মিডওয়াইফ ডিগ্রি নিচ্ছেন। সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা নার্স ও মিডওয়াইফদের বিশেষ কদর আছে।

আছে সামাজিক স্বাস্থ্যসেবা
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর খ্রিষ্টিয়ান হাসপাতাল চন্দ্রঘোনা কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া এবং রাঙামাটির কাপ্তাই এলাকায় পুনর্বাসন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পুষ্টিকর খাবার বিতরণ কর্মসূচি হাতে নেয়। পরবর্তী সময়ে সেটা কমিউনিটি হেলথ প্রোগাম বা সামাজিক স্বাস্থ্য কর্মসূচি হিসেবে বাস্তবায়িত হতে থাকে।এই কর্মসূচিতে ৭১ জন স্বাস্থ্যকর্মী ৬টি ইউনিয়নের ২০৫টি গ্রামে কাজ করছেন। এরা মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করেন, স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ব্যাপারে মানুষকে আগ্রহী করে তোলার কাজ করেন।হাসপাতালের পরিচালক প্রবীর খিয়াং বলেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে মানসম্পন্ন সেবা দেওয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে আমরা সেই চেষ্টাই করে আসছি। ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা নার্সরা সারা দেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। কুষ্ঠরোগীরা আমাদের এখানে সম্মানের সঙ্গে চিকিৎসা পান। আমরা সবকিছু করি আন্তরিকতার সঙ্গে।’

Leave a Comment