ক্লিন বয়

[১]

নাফিজ তার বন্ধু মহলে “ক্লিন বয়” হিসেবে পরিচিত। অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ছাড়া আজকাল ক্যাম্পাসে কেউ তাকে নাফিজ নামে চেনে না। এজন্য সে তার আইডি কার্ড সবসময়ই গলায় ঝুলিয়ে রাখে। যদিও সেদিকে কেউ খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করে না।

তার বন্ধুরা তাকে সবসময়ই পঁচায়। এই সেদিনকার একটি ঘটনা। সাত বন্ধু মিলে সাম্প্রতিক বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করছিল নাফিজরা। এমন সময় উদভ্রান্তের মতো একটি মেয়ে তাদের সামনে এলো। সবাই এমনভাবে হা হয়ে মেয়েটিকে দেখছিলো যে, দু’টি দম্পতি মাছি খুব সহজেই মুখপথ দিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারবে।

মেয়েটি সরাসরি নাফিজের দিকে তাকিয়ে বললো, “ভাইয়া, ম্যাথ ডিপার্টমেন্টটা কোনদিকে?”
মেয়েটির আগমন এবং প্রশ্ন দু’টোই আকস্মিক। নাফিজ বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেল। নিজেকে ধাতস্থ করে খানিকটা সময় নিয়ে সে লোকেশনটা বলে দিল। মেয়েটি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলেই যাচ্ছিল। কিছুদূর গিয়ে সে আবারও ঘুরে তাদের সামনে এলো। আন্তরিক ভঙ্গিতে নাফিজকে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু না মনে করলে, ভাইয়া আপনার নামটা কী জানতে পারি?”

সবাই নাফিজের দিকে তাকিয়ে সমসুরে বলে উঠলো, “এ্যাঁ?” নাফিজ একটু লজ্জা পেল। মুচকি এসে বললো, “আমার নাম….”
তাকে থামিয়ে দিয়ে আশিক বলে উঠল, “আপু, ওর নাম ক্লিন বয়।”
এই কথা বলার সাথে সাথেই সবাই উচ্চস্বরে হো হো করে হেসে উঠল।

মেয়েটা চোখ কপালে তুলে শুধু বললো, “ক্লিন বয়?” এরপর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আর কিছু না বলে দ্রুত চলে গেল।

তার সাথে প্রায়ই এরকম ছোটখাট মজা করে বন্ধুরা। প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো তার, এখন আর লাগে না।

[২]

নাফিজের পুরো নাম “মোহাম্মাদ মুনতাসির রহমান নাফিজ”। সে একটু বেশিই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে চায়। যেটা কখনো কখনো তার আশেপাশের লোকদের বিরক্তের উদ্রেক ঘটায়। আবার কখনো বা সকলের সামনে সে হাসির পাত্র হয়ে থাকে।

তার কিছু কার্যাকলাপ উল্লেখ করলে বিষয়টা বোধগম্য হবে। যেমন-

. রহিম চাচার চায়ের দোকানে নাফিজের বন্ধুরা সবাই বসে আড্ডা দেয়। চা-নাস্তা খায়। কিন্তু সে টঙের উপর বসার আগে তার রুমাল বিছিয়ে তারপর বসে। চায়ের কাপ সে নিজের হাতে পরিষ্কার করে তারপর চা নিয়ে খায়।

.হ্যান্ড স্যানিটাইজার তার কাছে সবসময়ই থাকে। সেটা খানিক পরপরই সে ব্যবহার করে।

এরম আরও অনেক কার্যবিধি দেখে,
প্রথম প্রথম তার বন্ধুরা ভাবতো সে নিশ্চয়ই শুচিবাইগ্রস্ত রোগী। এজন্য তারা জোর করে একজন সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে যায়। তিনি নাফিজের সাথে কথা বলে বুঝতে পারেন যে, তার এরকম কোনো রোগ নেই। বরং সে সবসময় পরিষ্কার থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এ কথা তিনি নাফিজের বন্ধুদেরও বলেন। বিষয়টি তারা বুঝতে পারে কিন্তু মজা নিতে ছাড়ে না।

একটু বেশিই শুচিশুভ্র জন্যই তাকে “ক্লিন বয়” বলে ডাকতে শুরু করে বন্ধুরা। তারপর থেকে পুরো ভার্সিটি তাকে ঐ এক নামে চিনে। সিনিয়র এবং ব্যাচমেটদের মধ্যে কারো সাথে দেখা হলে তারা কথা শুরুই করে এভাবে “কিরে ক্লিন বয়! কি খবর তোর?”
জুনিয়ররা তাকে দেখে বলাবলি করে, “ঐ দেখ ক্লিন বয় ভাই যাচ্ছে।”
তার ফোন নাম্বারও সকলের কাছে এই নামে সেভ করা।

এই বিষয়টা লক্ষ করেন তাদের ভার্সিটির জনৈক লেকচারার। তিনি একদিন নাফিজদের ক্লাস নেবার সময় খুবই কৌশলে এই বিষয়টা উপস্থাপন করেন।

এরপর তিনি কুরআনের একটি আয়াতের কথা উল্লেখ করেন এবং সেটির তাফসীরও তাদের শোনান। আয়াতটি হলো:

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا یَسۡخَرۡ قَوۡمٌ مِّنۡ قَوۡمٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُوۡنُوۡا خَیۡرًا مِّنۡہُمۡ وَ لَا نِسَآءٌ مِّنۡ نِّسَآءٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُنَّ خَیۡرًا مِّنۡہُنَّ ۚ وَ لَا تَلۡمِزُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ وَ لَا تَنَابَزُوۡا بِالۡاَلۡقَابِ ؕ بِئۡسَ الِاسۡمُ الۡفُسُوۡقُ بَعۡدَ الۡاِیۡمَانِ ۚ وَ مَنۡ لَّمۡ یَتُبۡ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۱۱﴾
ইয়া আইয়ুহাল্লাযীনা আ-মানূলা ইয়াছখার কাওমুম মিন কাওমিন ‘আছাআইঁ ইয়াকূনূ খাইরামমিনহুম ওয়ালা-নিছাউম মিননিছাইন ‘আছাআইঁ ইয়াকুন্না খাইরাম মিনহুন্না ওয়ালা-তালমিঝূআনফুছাকুম ওয়ালা-তানা-বাঝূবিলআলকা-ব বি’ছাল ইছমুল ফুছূকুবা‘দাল ঈমা-নি ওয়া মাল্লাম ইয়াতুব ফাউলাইকা হুমুজ্জা-লিমূন।
হে মু’মিনগণ! কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন মহিলা অপর কোন মহিলাকেও যেন উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করনা এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকনা; ঈমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এ ধরণের আচরণ হতে নিবৃত্ত না হয় তারাই যালিম। [সূরা হুজুরাত:১১]

এরপর তিনি সবার উদ্দেশ্যে বলেন, “তোমরা কী এই গর্হিত কাজ থেকে নিবৃত্ত হতে চাও নাকি যালিম হতে চাও? আমি জানি, তোমরা এখানে অনেকেই অনেক ধর্মাবলম্বীর শিক্ষার্থী আছো, আবার অনেকে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে চাও না। আমি সেই প্রসঙ্গে যাব না।

একটু থেমে তিনি আবারও বলতে শুরু করলেন-

কিন্তু তোমরা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টা একটু লক্ষ করো। আমি তোমাদের ভাবতে বলছি। এই বিষয়টা নিয়ে তোমরা একটু ভেবে দেখ।

একটা মানুষের নাম তার পরিচয় বহন করে। নামটা সাধারণ হলেও সেই ব্যক্তির কাছে কিন্তু তার নামটা অসাধারণ। মানুষের নিজের নামের সাথে তার আবেগ জড়িয়ে থাকে।

একটু মজার ছলে তোমরা কী তার আবেগে আঘাত করছো না? তার মনঃকষ্টের কারণ হতে কী খুব আত্মতৃপ্তি পাও তোমরা? যদি পেয়ে থাকো, তাহলে আমি বলবো তোমরা মানসিকভাবে অসুস্থ। একজন সুস্থ মানুষের চাওয়াটা কখনই অনৈতিক হতে পারে না।

আমি আশা করবো, তোমরা এখন থেকে কেউ কাউকে কখনই মন্দ নামে ডাকবে না। অনেকেই হয়তো তোমাদের কিছুই বলবে না বন্ধুত্বের খাতিরে। কিন্তু মনে মনে খুব কষ্ট পাবে। আর কষ্ট পেয়ে সে যদি এলটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তা তোমাদের জন্য বোধ করি সুখের হবে না।”

এরপর তিনি নিঃশব্দে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।

[৩]

পুরো ক্লাস জুড়ে পিনপতন নীরবতা। সবাই তাদের নিজেদের জায়গা থেকে অনুতপ্ত। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। লাস্ট পিরিয়ড ছিল। এখন আর কোনো ক্লাস নেই। তাই যে যার মতো চলে যাচ্ছে।

প্রতিদিনকার মতো আজ কোনো হৈ-হুল্লোর নেই। নাফিজের বন্ধুরা এখন আর তার সাথে কোনো কথা বললো না। নাফিজও তাই আর কথা বাড়ালো না। সিঁড়ি বেয়ে চুপচাপ নেমে গেল।

সে একাই চলে যাচ্ছিলো। হঠাৎ আসিফ ডাকলো, “এই নাফিজ”?

নাফিজ চমকে উঠে থমকে দাঁড়ালো। আসিফ তাকে আসল নামে ডাকলো! এ যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছিলো না। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো ক্লাসের সবাই ক্যাম্পাসের শতবর্ষীয় বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে। ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

কেমন যেন লজ্জা আর সংকোচ লাগছিল। তবুও সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। বন্ধুদের জটলার কাছাকাছি যেতেই আশিক দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, দোস্ত আমাদের ভুল গেছে। বিশেষ করে আমার। আমি তোকে নিয়ে সবসময়ই একটু বেশি মজা করেছি। তুমি আমাকে মাফ করে দে।

গুটি গুটি পায়ে সবাই তার কাছে চলে এলো। সবাই তাদের নিজেদের কার্যকলাপের কারণে মাফি মাঙ্গলো এবং বললে আর কখনো তারা এই ভুল করবে না।

খুশিতে চোখে পানি চলে এলো নাফিজের। সহসা সে মজা করে বলে উঠলো, এ সর সর! তোদের হাতে জার্ম আছে। আশিক তো আমাকে জড়িয়েই ধরেছে। এবার আর গোসল না করে উপায় নেই।

সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করে দিয়েছে।

____//ক্লিন বয়
লেখা: মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

Leave a Comment