ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে শুভ্র প্রাণের কাঁশফুল

শরৎ এলেই প্রকৃতি হেসে ওঠে প্রাণের সজীবতায়। বার্তাকক্ষ থেকে বলা হয়েছে কাঁশফুলের ছবি ও ভিডিও সংবলিত নিউজ করতে।

পৃথিবীতে কোনো ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের ফুলের এত কদর আর কোন দেশে আছে কি না জানা নেই। যতটা কদর রয়েছে কাঁশফুলের। বাংলা সাহিত্যের বেশ অংশজুড়ে থাকা সেই কাঁশফুল আগের মত দেখা মিলছে না হালের বাংলার প্রকৃতিতে। আগে গ্রামে-গঞ্জে পথের ধারে যেখানে সেখানে দেখা মিললেও এখন দেখা দুষ্কর। ক্রমশ বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে হারানোর উপক্রম হয়েছে ফুলটির।

ফেনী শহর থেকে বাস যোগে আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে মহাসড়ক থেকে আনুমানিক দুইশো গজ পেরিয়েই রেল লাইনের দুই পাশে দেখা মিললো কাঁশফুলের। সেখানে বর্ষার আকাশে মেঘের দল ভেঙে গিয়ে উঁকি দিচ্ছে নীলের উজ্জ্বলতা। সবুজ শ্যামল প্রান্তরে ফুটেছে শুভ্র নরম কাশফুল। এ যেন নীল আর শুভ্রের রাজত্ব। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরতে এ ফুলকে স্বাগত জানিয়ে যেমনটা বলেছিলেন, এসো গো শারদলক্ষী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে, এসো নির্মল নীলপথে, এসো ধৌত শ্যামল আলো ঝলমল বনগিরিপর্বতে, এসো মুকুটে পরিয়া শ্বেতশতদল শীতল শিশির ঢালা।
পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়নই ফুলটি হারিয়ে যাওয়ার কারণ বলে মনে করছেন পরিবেশবাদী ও প্রকৃতি প্রেমীরা।

তারা বলছেন নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় নদীর তীরে কাশের ঝাড় দেখা যেত। এখন সেসব যায়গায় গড়ে উঠছে বাড়ি ঘর, কল কারখানা।

এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ সবুজ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদারের সাথে।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়ার পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। ষড়ঋতুর দেশ দুই ঋতুতে পরিণত হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও পরিবেশ বিপর্যয় কাশফুল হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে শরৎকালের কাশফুলের দেখা মিলছে না।

ফেনী সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক মোশারফ মিলন বাংলানিউজকে বলেন, এটি একটি ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। কাশ ঘাসের বৈজ্ঞানিক নাম saccharum spontaneum । ইংরেজি নাম Kans grass।

বাংলাদেশের নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো রুক্ষ এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। তবে নদীর তীরেই এদের বেশি জন্মাতে দেখা যায়। কারণ, নদীর তীরে পলিমাটির আস্তর থাকে এবং এ মাটিতে কাশের মূল সহজে সম্প্রসারিত হতে পারে। শরত ঋতুতে সাদা ধবধবে কাশফুল ফোঁটে। যে সব অঞ্চলে সাধারণত নদী তীর এবং পানির কাছাকাছি ফাকা বালুময় জমি থাকে সেখানে প্রচুর কাশফুল দেখতে পাওয়া যায়।

কাশফুলের মঞ্জুরী দন্ড ১৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার লম্ব হয়ে থাকে, বীজে সুক্ষ্ম সাদা লুম থাকে। কাশ উদ্ভিদ প্রজাতির, উচ্চতায় তিন মিটার থেকে পনের মিটার লম্বা হয়ে থাকে। আর এর শেকড় গুচ্ছমূল থাকে। পাতা রুক্ষ ও সোজা। পালকের মতো নরম আর সাদা সাদা ফুল। কাঁশফুল শুভ্রতার অর্থেও ভয় দূর করে শান্তি বার্তা বয়ে আনে। আর এ জন্যই শুভ কাজে ব্যবহার করা হয় কাঁশফুলের পাতা বা ফুল। কাঁশফুল পালকের মতো নরম এবং রঙ ধবদবে সাদা। গাছটির চিরল পাতার দুই পাশ খুবই ধারালো।

শরতকাল অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে সাধারণত কাঁশফুল ফুটে। তবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে কাঁশফুলের দেখা বেশি পাওয়া যায়। শ্রাবণ মাস শেষে ভাদ্র মাসের শুরুতে তথা শরতের আগমনে বর্ষা ঋতুকে বিদায় জানিয়ে প্রকৃতি বরণ করতে চলে শরৎকালকে। আর শরৎকে স্বাগত জানাতে মেতে উঠে কাশঁফুল।

উদ্ভিদ বিজ্ঞানের এ শিক্ষক আরও জানান,এ ফুলটির বেশ কিছু ঔষুধি গুনও রয়েছে। পিত্তথলিতে পাথর হলে নিয়মিত গাছের মূলসহ অন্যান্য উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি করে পান করলে পিত্তথলির পাথর দূর হয়। কাঁশমূল বেটে চন্দনের মতো নিয়মিত গায়ে মাখলে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়। এ ছাড়াও শরীরে ব্যথানাশক ফোঁড়ার চিকিৎসায় কাঁশের মূল ব্যবহৃত হয়। কাঁশফুল আগাছা হিসেবে বিবেচিত হলেও শুকনো কাঁশগাছ খুব কাজের জিনিস। তাই বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে কাঁশফুলের।

কাঁশফুল বন্দনার শেষ করতে চাই কবি নির্মলেন্দু গুনের কবিতা পংক্তি দিয়ে। তিনি লিখেছিলেন,

শরত রানী যেন কাশের বোরখা খানি খুলে,
কাশ বনের ওই আড়াল থেকে নাচছে দুলে দুলে।

প্রথম কবে ফুটেছে কাশ সেই শুধুরা জানে,
তাইতো সেটা সবার আগে খোঁপায় বেঁধে আনে।

ইচ্ছে করে ডেকে বলি, “ওগো কাশের মেয়ে―
আজকে আমার চোখ জুড়ালো তোমার দেখা পেয়ে
তোমার হাতে বন্দী আমার ভালোবাসার কাশ
তাইতো আমি এই শরতে তোমার কৃতদাস”

Leave a Comment