কোথায় লাগে? কীভাবে লাগে?

অর্থমন্ত্রী হিসেবে জনাব আ হ ম মোস্তফা কামাল

যেকোনো খারাপ কাজে অনেকেরই খারাপ লাগতে পারে। সেটিই স্বাভাবিক। কারণ আমরা বিশ্বাস করতে চাই, এ দেশে ভালো লোকের সংখ্যাই বেশি। খারাপ কাজে যাঁদের ভালো লাগে, তাঁরা যে প্রকৃতিগতভাবে ভালো নন, সেটি বুঝতে খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেই খারাপ লাগার মাত্রাটা কতটুকু? কোনো একটি খারাপ কাজে কার কোথায় আঘাত লাগে, আর সেই আঘাতের মাত্রা কতটুকু, তার ওপর বোঝা যায় ওই কাজে কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত।

খারাপ লাগার বিষয়টি সম্প্রতি আলোচনায় উঠে এসেছে অর্থ পাচারের বিষয়টিকে উপজীব্য করে। গতকাল সোমবার সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনা হয়। তাতে বিরোধী দলের সাংসদেরা অর্থ পাচার নিয়ে বেশ সমালোচনা করেন। তাঁরা অর্থ পাচার ঠেকানোর কৌশল অবলম্বন করার পরামর্শও দিয়েছেন। এসবের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশে চলে গেলে আপনাদের যেমন লাগে, আমারও লাগে। আমি যেকোনো অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে।’

সংসদে দেশের অর্থ পাচার নিয়ে আলোচনার অর্থ হলো, এটি এখন একটি প্রকাশ্য ও আনুষ্ঠানিক বিষয়। বিরোধী দলের সদস্যরা অভিযোগ করছেন। সরকারি দলের সদস্যরা তার বিরোধিতাও করে থাকেন। এটি এ দেশীয় রাজনীতির চিরাচরিত কলাকৌশল। যাঁরা অভিযোগ করছেন এখন, তাঁরাও একদা অস্বীকারের রাজনীতির চর্চা করে এসেছেন। আবার এখন যাঁরা অস্বীকার করে থাকেন, তাঁরাও উল্টোটা করেছেন। তবে মোদ্দা কথা হলো, এই অভিযোগ ও অস্বীকারের চর্চার মধ্যেই দেশ থেকে যে অসীম পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, সেটি অন্তত স্পষ্ট হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী অবশ্য অর্থ পাচার বন্ধ করার বিষয়ে একমত হয়েছেন। এ ব্যাপারে বিরোধী দলের সহায়তাও চেয়েছেন। বিষয়টিতে তাঁকে অভিবাদন জানানোই উচিত। অন্তত অস্বীকারের রাজনীতি থেকে তিনি বের হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে তিনি এটিও বলেছেন, ‘কারা অর্থ পাচার করেন, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন যে এঁরা এঁরা অর্থ পাচার করেন, আমাদের দিন।’

এখন প্রশ্ন হলো, মন্ত্রীর কাছে এ তালিকা না থাকার মানে কী দাঁড়ায়? হতে পারে সরকার এটিকে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করছে না। নাকি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে পাওয়ার আশঙ্কা আছে? দ্বিতীয় প্রশ্নটি যৌক্তিকভাবেই উঠছে। কারণ পি কে হালদারের ক্ষেত্রে আমরা সেটিই প্রত্যক্ষ করেছি।

অথচ দেশে ও দেশের বাইরে অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গত পাঁচ অর্থবছরে অর্থ পাচারের এক হাজারের বেশি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক ঘটনায় দেশের বাইরে অর্থ পাচারের প্রমাণ মিলেছে। অর্থ পাচারসংক্রান্ত আইনে দেশের মধ্যেও অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে।

সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, সংস্থাটি যেসব ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে, তার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে। যেসব সংস্থার কাছে এসব প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে তথ্যপ্রমাণ থাকার পরও এসব ঘটনায় কোনো সংস্থা খুব বেশি ব্যবস্থা নেয়নি।

এসব খবর শোনার পর যখন আমরা সংসদে অর্থমন্ত্রীকে বলতে শুনি, অর্থ পাচারকারীদের তালিকা তাঁর কাছে নেই, তখন আমাদের ‘সত্যিই লাগে’। আমার-আপনার পরিচয় কী? উত্তরে বলতে হয়, সাধারণ করদাতা। এই সাধারণের দেওয়া টাকাগুলোই বিদেশে বা দেশের মধ্যে পাচার হয়। আবার দিন শেষে বড়রাই পায় নানা প্রণোদনা। অর্থাৎ সাধারণেরা টাকার জোগান শুধু দিয়েই যাচ্ছেন। বিনিময়ে দেখতে হচ্ছে, অর্থ পাচার হলেও সেগুলোর কার্যকর প্রতিকারের বিষয়ে উদ্যোগ কতটা কম! যদিও কালোটাকার অবাধ রং বদলে উৎসাহ-উদ্দীপনার কোনো কমতি নেই। এবারের বাজেটেও তা বজায় আছে। উল্টো কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তায় কালোটাকা কতটা আদরণীয়, সেই ইঙ্গিতও মিলছে।

এবার শুরুর প্রশ্নে ফিরে যাই। এই যে অর্থ পাচার হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে এবং সবশেষে শুনতে হচ্ছে, এ-সংক্রান্ত তালিকা সহজলভ্য নয়—এই পুরো চক্র প্রত্যক্ষ করতে করতে সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে আসলে আমার-আপনার মতো সাধারণদের। আমরা অর্থের জোগান দিচ্ছি, বিনিময়ে তেমন কিছু পাচ্ছি না এবং পরবর্তী সময়ে দেখছি ফল খাচ্ছে কাঠঠোকরায়।

সুতরাং সমব্যথী হতে যাঁরা চাইছেন, তাঁদের আমরা স্বাগত জানাই। তাঁদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞও। তবে আমাদের মতো আমজনতার যতটা নিদারুণ ‘লাগে’, তাঁদের যে ততটা ‘লাগে’ না সেটি হলফ করেই বলা যায়। কারণ অনুভূতি একই হলে সমব্যথীরা এত দিনে বিহিত করে ফেলতেন নিশ্চয়ই। যেহেতু বুকের চিন চিন ব্যথাটা মাত্রায় ‘প্রচণ্ড’ নয়, তাই চিকিৎসকের কাছেও যাওয়ার গরজও কম।

অর্থমন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, আর্থিক খাতের শৃঙ্খলার জন্য আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে ১৫টি আইন জাতীয় সংসদে যাবে। আমরাও তাতেই ভরসা রাখতে চাই। কথায় আছে, আশায় বাঁচে চাষা। তাই আমাদেরও প্রত্যাশা, একদিন তাঁদের অনুভূতি ‘প্রচণ্ড’ হবে। তবেই না চাষারা বাঁচবে!

By নিজস্ব প্রতিবেদক

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *