কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে নতুন ইসি কঠোর থাকতে চায়

আসন্ন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কঠোর অবস্থানে থাকতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নিজেদের কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে এমনই বার্তা দিচ্ছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন এ কমিশন।

আগামী ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এর এক মাস আগে থেকেই বিজিবি মোতায়েন, মাঠে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নামানো এবং ভোটের আগে-পরে কয়েক দিন প্রতিটি ভোটকেন্দ্র ও আশপাশের এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইসি কতটুকু স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও আইনানুগভাবে কাজ করছে তা বোঝা যাবে মূলত নির্বাচনী প্রচার–প্রচারণা শুরু হওয়ার পর ও ভোটের দিন। এ সময় পুলিশ ও প্রশাসন কতটুকু ইসির নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সব প্রার্থী নির্বাচনের মাঠে সমান সুযোগ পাচ্ছেন কি না, বিরোধী মতের প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন কি না, তা দেখতে হবে। এ ছাড়া আচরণবিধি বা আইন ভঙ্গ করলে প্রার্থী, তাঁদের সমর্থক ও সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ইসির অবস্থান কী হয়—সেটিও বিবেচ্য বিষয়।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন শপথ নেয়। শপথ নেওয়ার সাড়ে তিন মাসের মাথায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে ভোট গ্রহণ হচ্ছে। নতুন কমিশনের অধীনে এটিই প্রথম বড় নির্বাচন। এই কমিশনের অধীনেই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ করছে ইসি।

অবশ্য ইসির অধীন প্রথম এ নির্বাচন সে অর্থে অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি এতে অংশ নিচ্ছে না। তবে দলটির নেতা ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বিদায়ী মেয়র মনিরুল হক ও কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নিজাম উদ্দীন কায়সার ইতিমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। অন্যদিকে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হচ্ছে আগামী মঙ্গলবার। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ২৬ মে। এর পর থেকেই শুরু হবে প্রচার–প্রচারণা। সাধারণত নির্বাচনগুলোতে ভোটের কয়েক দিন আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি থাকে র‍্যাব ও বিজিবি। তবে কুমিল্লা সিটিতে নির্বাচনী প্রচার–প্রচারণা শুরুর আগে আগামীকাল রোববার থেকে মাঠে নামছে এক প্লাটুন বিজিবি।

ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা, পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকাও পর্যবেক্ষণে রাখবে ইসি। এ জন্য আলাদা দল গঠন করা হবে। তারা নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করবে। ইভিএমে ভোটার আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর অন্য কেউ যেন ভোটের বোতাম চেপে দিতে না পারেন, সে লক্ষ্যে বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকেই ইসি কঠোর বার্তা দেবে।

নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ—প্রতিটি নির্বাচনই ইসির কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পাশাপাশি একই দিন ছয়টি পৌরসভা ও শতাধিক ইউনিয়নে নির্বাচন হচ্ছে। কমিশন নিয়মিত সব রিটার্নিং কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছে, যাতে কোনো ধরনের অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্ব না হয়।

যেকোনো সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের বিষয় বিবেচনায় রেখে এক মাস আগে থেকে কুমিল্লায় বিজিবি মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে উল্লেখ করে আহসান হাবিব বলেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৎপর আছেন। পুলিশের বিশেষ সাঁড়াশি অভিযানে ৩৪৮টি মোটরসাইকেলের বিপরীতে ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটরা এখন পর্যন্ত ১৯টি মামলা করেছেন। ভোটের আগে-পরে তিন থেকে চার দিন ভোটের গোপন কক্ষ ছাড়া সব ভোটকেন্দ্র ও চারপাশের এলাকা সিসিটিভি মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করা প্রয়োজন, আইনের মধ্যে থেকে ইসি সব করবে।

বিএনপি না থাকায় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে কি না—প্রশ্নের জবাবে মো. আহসান হাবিব খান বলেন, দলীয়ভাবে না থাকলেও বিএনপির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।

সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসির অধীনও প্রথম বড় নির্বাচন ছিল কুমিল্লা সিটি নির্বাচন। ২০১৭ সালে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অভিযোগ করেছেন, কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন ও নূরুল হুদা কমিশনের আমলে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। নতুন কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে নির্বাচনব্যবস্থা ও ইসির প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৩ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হয়েছিল। কারণ, সেসব নির্বাচনে সরকার হস্তক্ষেপ করেনি। তাঁর আশা, কুমিল্লা সিটি নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—ইসি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে কি না, মানুষ ভোট দিতে আসবে কি না।

কুমিল্লা সিটি নির্বাচন সামনে রেখে ইসি যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেগুলো করা সহজ বলে মন্তব্য করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘কিন্তু যারা নির্বাচনী অনিয়ম করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ইসির অবস্থান কী, সেটা দেখতে হবে। আস্থা অর্জনের জন্য আগে যারা নির্বাচনী অপরাধ করেছেন, আর্থিক অনিয়ম করেছেন, তদন্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ইসিকে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

 

Leave a Comment