এরকম জীবন্ত মিরাকেল নিজের চোখে দেখার পরো কি মানুষ কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে?

Writing-Therapy🌻:
নামাজ শেষ করে মসজিদের মুসল্লায় মধ্যবয়স্ক জর্ডানিয়ান এক ভদ্রলোক জবুথবু হয়ে বসে আছেন। উনাকে দেখেই মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। আমার হাজব্যান্ড জিয়া, ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেলেন। সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেক করার জন্য। তিনি কেমন একটা শূন্য দৃষ্টিতে জিয়ার দিকে তাকালেন, মনে হচ্ছিল হ্যান্ডশেক করতে হাত উঠানোর মতো কঠিন কাজ দুনিয়াতে আর একটাও নেই। এই জর্ডানিয়ান ভদ্রলোকের নাম ধরলাম মুয়ায (ছদ্মনাম)।

: “কি ভাই ? সব ঠিকঠাক আছে তো?
: “নারে ভাই, কিছুই ঠিক নেই …”
: “কি হয়েছে আপনার বলেন ?”
: বলবো? সময় আছে তোমার হাতে?
: আমার হাতে সময় আছে, আপনি সব খুলে বলেন …
: ঠিক আছে আমার পাশে বসো তুমি.. আমি বলছি …

জিয়া সাথে সাথে পাশে বসে গেল। বসতে বসতে আমাকে একটা ছোট্ট টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে দিল, “মসজিদ থেকে বের হতে দেরী হবে!” আমি যা বুঝার বুঝে নিলাম।

মুয়ায ভাইয়ের গল্পটা খুব কষ্টদায়ক। একদম চল্লিশোর্ধ চাঙ্গা শরীরের একজন মানুষ হঠাৎ করে আর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারছেন না। শুরুতে দেখা গেল যে তিনি জামাতের নামাজ গুলো চেয়ারে বসে বসে পড়ছেন। আবার বসেও তিনি শান্তি পাচ্ছেন না। বেশিক্ষণ বসলেও মেরুদন্ডের নার্ভগুলোতে কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা হয়। তিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না। ড্রাইভ করতে পারছেন না। বেশিক্ষণ চাপ দিয়ে গাড়িতে বসে থাকলে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়। জীবনযাত্রা যেন থমকে যাচ্ছে! হন্যে হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন।

ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলো, তার মেরুদন্ডের হাড় গুলোর মাঝখানে যে রাবারের মতো ডিস্ক থাকে, সেখান থেকে কিছু লিকুইড বাইরে বের হয়ে তার নার্ভকে পিন্চ করছে। এরকম আরো বেশ কিছু প্রবলেম এমআরআই ইমেজে দেখা গেল। সবগুলোর নামও তার ঠিক মনে নেই।

মুয়ায ভাই‌ বলেন, “দেখো ভাই! আল্লাহ রব্বুল আলামীন কত দয়াময়। জীবনের ৪০+ বছর ধরে ফ্রি সার্ভিস নিয়ে আসছি আল্লাহর কাছ থেকে। তিনি এত বছর ধরে আমার মেরুদন্ড সুস্থ রেখেছেন! মেরুদন্ডের হাড়ের মাঝখানে রাবারের মত একটা আবরণ দিয়ে দিয়েছেন; যাতে হাড়ে হাড়ে ঘষা খেয়ে নড়াচড়া করার সময় আমি সময় কষ্ট না পাই। রাবারের এই আবরণ যা বাফার হিসেবে কাজ করে! এই এক আবরণের শুকরিয়া গত ৪০+ বছরে ধরে কত ভালোভাবে করেছি বলো ? যেভাবে করার কথা হয়তো করতে পারিনি!

দেখো মাত্র এই একটা ডিস্কের আবরণটা একটু উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে, আর আমার পুরো পৃথিবীটা যেন উল্টে গেল! এখন বল আল্লাহ যদি আমাকে না বাঁচান, আমি কার কাছে যাব?”

মনে হচ্ছিল তিনি কথাগুলা বলতে বলতে কেঁদে দিবেন। তিনি আরো বলছিলেন ডাক্তাররা সার্জারির কথা বলছে। খুব এগ্রেসিভ সার্জারি। সার্জারির রিস্ক আছে, ভয় আছে। একটু চাকুতে বেশ-কম হলে সারা জীবনের জন্য প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারেন! আবার এমন না যে, সার্জারির সম্পূর্ণ টাকা দেয়ার সামর্থ্যও এই মানুষটার আছে। সব মিলিয়ে সার্জারির ধার কাছে তিনি যেতে চান না। কিন্তু কি করবেন? মেরুদন্ডের ভেতরে কি হচ্ছে সেটার ওপর তার কি-ই বা কন্ট্রোল আছে? আমরা মানুষরা কি অসহায়! আর কতই না বোকার মত বড়াই করে বেড়াই!

জিয়া ভাইটার পিঠে হাত রাখল। বলল, “ভাই আপনি তো এখন আল্লাহর ঘরে আছেন, পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ জায়গা গুলোর মধ্যে একটা। আমরা সবাই আপনার জন্য দুয়া করছি। আপনি ট্রিটমেন্ট নিতে থাকেন, ভয় পাবেন না। টাকাপয়সা অথবা অন্যান্য জিনিসের কথা ভাববেন না। আমরা এতগুলো ভাই আছি কিসের জন্য?”

আরো কি কি তারা কথা বলল সেদিন আমি জানিনা। কিন্তু মুয়ায ভাইয়ের জন্য আমাদের মনটা খারাপ থাকলো সেদিন সারাদিন। একটা মানুষ দাঁড়াতে পারছে না, বসতে পারছে না, শুয়ে থাকতেও পারছে না! অথচ আল্লাহর সামনে হাজিরা দিতে মসজিদে ঠিকই চলে আসছে!! সুবহান আল্লাহ!

এরপর আর কী হলো? যেটা সাধারণত হয়!
নিজেদের যার যার দায়িত্ব আর সংসার নিয়ে আমরা বিভিন্ন দিকে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। মুয়ায ভাইয়ের গল্পটাও ব্রেইনের স্টোররুমের কোন এক কর্ণারে অবহেলায় পড়ে থাকল‌।

আরো কয়েক সপ্তাহের পরের ঘটনা!
জিয়া সেদিন খুব এক্সাইটেড হয়ে মসজিদ থেকে বাসায় ফিরলো। আমি ভাবলাম, কি ব্যাপার? মিলিয়ন টাকা মাটি থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে নাকি?? কে জানতো জিয়া যে খবর নিয়ে বাসায় আসছে সেটা মিলিয়ন ট্রিলিয়ন টাকার থেকেও কত দামি!!

জিয়া বললো, “তোমার মুয়ায ভাইয়ের কথা মনে আছে?
: “হ্যাঁ, খুব মনে আছে!”
: “আরে আমাদের মুয়ায ভাই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন! আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন!”

আমি তো খুব খুশি!! আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ!!
: “ভাই তাহলে শেষ পর্যন্ত সার্জারি করালেন?”

: “নাহ! কোন সার্জারি না, কোন ওষুধ না, কোন ডাক্তার না, কোন মানব রচিত ঠুনকো পৃথিবীর গ্যাজেট ভাইকে সুস্থ করেন নি ….’

আমারতো কৌতুহল আরো বাড়তে লাগলো… “তাহলে কীভাবে ভাই সুস্থ হয়ে হলেন?”

তিনি বলা শুরু করলেন, “তুমি তো জানো ভাই কি পরিমাণ অসহায় এবং নিরুপায় অবস্থায় সময় কাটাচ্ছিলেন দিনের পর দিন! বসলেই নার্ভের ব্যথা! গাড়ি চালানো ছেড়ে দিলেন। চাকরিটা কি তাহলে চলেই যাবে কিনা সেটাও কত বড় দুশ্চিন্তা! দাঁড়িয়ে থাকলেও ব্যথা! বসে বসে নামাজ পড়লেও ব্যথা। আর শুয়ে থাকলেও সারা রাত তিনি ঘুমাতে পারতেন না, ব্যথায় খালি ছটফট করে এপাশ-ওপাশ করতেন …

এরকমই এক গভীর রাতের কথা। প্রচন্ড ব্যাথায় ভাই ঘুমাতে পারছেন না। ডাঙ্গায় তরপানো মাছের মতো এপাশ-ওপাশ করছেন! একবার বিছানা থেকে উঠেন, আবার শুয়ে পড়েন। একটা ফোঁটা শান্তি পাচ্ছেন না। চূড়ান্তভাবে শেষ মুহুর্তে আর না পেরে তিনি আর্তনাদ করে কাঁদতে কাঁদতে জাস্ট আল্লাহকে ডেকে উঠলেন,

“আল্লাহ আমি তো আর পারছিনা … আমি আর পারছিনা আল্লাহ!! আপনি তো সব দেখছেন … আপনি তো সব জানেন আমার কি পরিমান কষ্ট হচ্ছে ‌… আল্লাহ আপনি যদি এখন আমাকে রহম না করেন, আমি তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি… ”

কথাগুলো মুখ থেকে বের হয়নি, একদম ঈমানদারের অন্তর থেকে বের হয়েছে। খুব অদ্ভুত ভাবে তখন মুয়ায ভাইয়ের মনে হলো, তার এখন সূরা ফাতিহা পাঠ করা উচিত!! তিনি ওই অবস্থাতেই আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে সূরা ফাতিহা তেলাওয়াত শুরু করলেন। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত … প্রত্যেকটা হরফ বুঝে বুঝে … কেঁদে কেঁদে অন্তরের ভেতর থেকে … তারপর প্রচন্ড ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন…

ঘুম থেকে উঠে পরের দিন থেকে তার আর কোনো ব্যথা নেই!! আল্লাহু আকবার!!
মানে একেবারে সমস্ত ব্যথা উধাও। কোন সার্জারি করা লাগেনি। ওষুধের পেছনে একটা পয়সাও খরচ করা লাগেনি!

আমাদের মসজিদের মুয়ায ভাই এখন সম্পূর্ণ সুস্থ! এইতো গেলো রামাদানেই তিনি ঘন্টা পাড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে তারাবির নামাজ পড়লেন আলহামদুলিল্লাহ। রুকু সিজদা করতে পারছেন কোন রকম ব্যথা ছাড়াই!! ড্রাইভ করে আবার কাজেও যেতে পারছেন! আলহামদুলিল্লাহ।

অবশ্যই সূরা ফাতিহাতে শিফা আছে এবং আল্লাহর কালামে শিফা আছে! সেই চিরচেনা সূরা ফাতিহা যেটা আপনার-আমার কমপক্ষে ১৭ বার করে প্রতিদিন পড়ার কথা! সেই সূরা ফাতিহার কোন প্রভাব আছে আমাদের জীবনে?

শুধু বুলি আওড়ালেই কাজ হয়না। ব্যাপারটা গভীর বিশ্বাসের! ব্যাপারটা আন্তরিকতার! ব্যাপারটা একটা কৃতজ্ঞ অন্তরের যা চরম পরীক্ষার মুহূর্তেও কখনো মুখ থেকে খারাপ কথা উচ্চারণ করেনা।

মুয়ায ভাইয়ের সাথে ওই রাতে তো আর আমরা উপস্থিত ছিলাম না! কিন্তু এই যে অসহায় অসুস্থ একটা মানুষকে নিজের চোখে দেখলাম মসজিদে নামাজ পড়তে পর্যন্ত পারছেন না!! সেই জায়গা থেকে এখন সে দৌড়ে দৌড়ে মসজিদের কাজ করছে, প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে!!

এরকম জীবন্ত মিরাকেল নিজের চোখে দেখার পরো কি মানুষ কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে??

আল্লাহর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে?

(প্রকৃত সত্য ঘটনা অবলম্বনে …)

___
আমার #মসজিদ_ডায়েরী
পর্ব ৫
২৬ শাওয়াল, শুক্রবার, ১৪৪৩

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *