মাত্র ৯ দিনের ব্যবধানে দেশে দৈনিক করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২ থেকে সাড়ে ৯ হাজারে পৌঁছেছে। প্রায় দুই বছর ধরে চলা করোনা মহামারিতে দেশে এর আগে কম সময়ে এত দ্রুত রোগী বাড়তে দেখা যায়নি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ মাত্র শুরু হয়েছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হবে।
গত ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) দেশে ৯ হাজার ৫০০ করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ২৫ শতাংশের বেশি। এক দিনের ব্যবধানে নতুন রোগী বেড়েছে ১ হাজার ৯৩ জন। আর আগের সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে (১৩ থেকে ১৯ জানুয়ারি) নতুন রোগী বেড়েছে ২২৮ শতাংশ। এ সময় মৃত্যু বেড়েছে ১৮৫ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, করোনার নতুন ধরন অমিক্রনের কারণে এখন দ্রুত সংক্রমণ বাড়ছে। এমন দ্রুত সংক্রমণ আগে দেখা যায়নি। হাসপাতালে যাঁরা ভর্তি হচ্ছেন, তাঁরা করোনার ডেলটা ধরনে বেশি আক্রান্ত। এর মানে হচ্ছে অমিক্রনের পাশাপাশি ডেলটা ধরনও সক্রিয়।
আবু জামিল ফয়সাল বলেন, যাঁরা টিকা নেননি বা এক ডোজ নিয়েছেন, যাঁদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যাসহ স্বাস্থ্যগত জটিলতা আছে, তাঁদের ঝুঁকি বেশি। এখনই হাসপাতালগুলোতে প্রস্তুতি নেওয়ার ওপর তিনি তাগিদ দেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে মোট ৩৭ হাজার ৮৩০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তাতে করোনা শনাক্ত হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার ব্যক্তির। সর্বশেষ এর থেকে বেশি রোগী শনাক্ত ছিল গত বছরের ১২ আগস্ট। ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ২৫ দশমিক ১১ শতাংশ। গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে করোনা শনাক্ত ১ শতাংশের ঘরেই ছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। তাঁদের মধ্যে ১০ জন পুরুষ ও ২ জন নারী। আটজনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা বিভাগে। চট্টগ্রামে দুজন এবং রাজশাহী ও সিলেট বিভাগে একজন করে মারা গেছেন।
২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এখন পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৬ লাখ ৪২ হাজার ২৯৪ জন। সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৮ হাজার ১৭৬ জনের। এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ২৬৮ জন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৪৭৩ জন সুস্থ হয়েছেন।
এবারই রোগী বাড়ছে দ্রুত
দেশে ২০২০ সালের জুন-জুলাই মাসে করোনার প্রথম ঢেউয়ে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়ে। সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয়েছিল ২ জুলাইয়ে ৪ হাজার ১৯ জন। সে সময় এক সপ্তাহে (২৬ জুন-২ জুলাই) রোগী বেড়েছিল প্রায় ৪ শতাংশ। প্রথম ঢেউয়ে দৈনিক রোগী শনাক্ত ২ হাজার ছাড়িয়েছিল ৩১ মে। সে হিসাবে এক মাসের বেশি সময় পর রোগী শনাক্ত ৪ হাজার ছাড়ায়।
গত বছরের মার্চে করোনার ডেলটা ধরনের কারণে দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। সে সময় কিছুদিন শনাক্ত রোগী হাজারের নিচে ছিল। এরপর ১০ মার্চে সংখ্যাটি হাজার ছাড়িয়েছিল। তখন সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৭ এপ্রিল (৭ হাজার ৬০০)। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ থেকে ৭ হাজারে পৌঁছাতে এক মাসের বেশি সময় লাগে।
এরপর রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমে এক হাজারের আশপাশে ছিল। পরে আবারও তা বাড়তে শুরু করে। ৮ জুলাই এসে শনাক্ত রোগী ২ হাজার ছাড়ায়। ১১ দিন পর ১৯ জুলাইয়ে নতুন রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৩২১। আর ২৮ জুলাই ছিল সর্বোচ্চ শনাক্ত রোগী, ১৬ হাজার ২৩০ জন। এ সময়ে ঈদের ছুটি ছিল চার দিন। ছুটির মধ্যে নমুনা পরীক্ষা তুলনামূলক কম হয়েছিল। ফলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও মাঝে কমেছিল। সে ক্ষেত্রে গত বছর জুলাইয়ে ১০ দিনের ব্যবধানে রোগী বেড়েছিল প্রায় ২২ শতাংশ।
এ বছরে করোনার অতি সংক্রামক ধরন অমিক্রনের সামাজিক সংক্রমণের কারণে আবারও দেশে রোগী বাড়তে শুরু করেছে। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে যেখানে দৈনিক রোগী শনাক্ত ৫০০-এর ঘরে ছিল, সেখানে ধারাবাহিকভাবে বেড়ে তা ২ হাজার ছাড়িয়ে যায় ১০ জানুয়ারি। এরপর এক সপ্তাহ না হতেই দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়ে গেল।
গতকাল ভার্চ্যুয়াল বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। শনাক্ত বাড়লেও হাসপাতালে করোনা রোগী বাড়েনি। তবে এতে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। সাধারণত কোনো নতুন ভেরিয়েন্ট (ধরন) এলে সেটি পুরোনো ধরনকে প্রতিস্থাপন করে। তবে এখন পর্যন্ত দেশে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, তাতে করোনার ডেলটার ধরনই বেশি ছড়াচ্ছে। গত বছর ডেলটা ধরনের তাণ্ডব দেখা গেছে। তাই অসতর্ক হওয়ার সুযোগ নেই।
গত ৯ ডিসেম্বর দেশে প্রথম করোনার অমিক্রন ধরন শনাক্তের খবর জানা যায়। দেশে গতকাল পর্যন্ত ৫৫ জন অমিক্রনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫২ জনই ঢাকার বাসিন্দা।
করোনার উচ্চ ঝুঁকিতে আরও ১০ জেলা
ঢাকা ও রাঙামাটির পর আরও ১০ জেলাকে করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়া মধ্যম ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে ৩২ জেলা। আর এখন পর্যন্ত ঝুঁকিমুক্ত ১৬ জেলা।
গত এক সপ্তাহের তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলো হলো গাজীপুর, রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, বগুড়া, দিনাজপুর, রাঙামাটি, লালমনিরহাট, খাগড়াছড়ি ও পঞ্চগড়। এর আগে ১২ জানুয়ারি ঢাকা ও রাঙামাটি জেলাকে করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যে দেখা যায়, রাজধানীতে করোনা সংক্রমণের হার ২৮ দশমিক ১১ শতাংশ, রাঙামাটিতে যা ১০ দশমিক ৭১। করোনার মধ্যম ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলোর সংক্রমণের হার ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে। আর কম ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলোর করোনা শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে।