আপনি কি বেকার? আপনি কি ঘরে বসে অনলাইনে পার্টটাইম কাজ করতে আগ্রহী? তাহলে দেরি না করে দ্রুত শুরু করুন। প্রতিদিন আয় করুন। বিজ্ঞাপন দেখে, পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে অথবা রেফার করে আয় করুন।
বিভিন্ন কোম্পানির এমন লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখে যে কেউ লোভে পড়ে আকৃষ্ট হতে পারেন। বিশেষ করে ফেসবুকে অলস সময় কাটানো বেকার যুব প্রজন্ম তারা সহজেই লুফে নেয় এমন অফার।
এমন অফার থেকে প্রথম প্রথম আয় হলেও এক পর্যায়ে গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে পথে বসিয়ে উধাও হচ্ছে নামসর্বস্ব এসব কোম্পানি।
এমনি একটি কোম্পানি তাদের তথ্য গোপন করে জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজাকে শুভেচ্ছা দূত বানিয়েছিল। পরে তিনি তাদের বিষয়ে জানতে পেরে ওই কোম্পানির শুভেচ্ছা দূতের পদ থেকে সরে যান মাশরাফি।
পরে মাশরাফি তার স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘গত এপ্রিলে আমি ‘এসপিসি ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম। তাদের সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল, ‘শুভেচ্ছা দূত’ হিসেবে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রচারে আমার ছবি ও ধারণকৃত ভিডিও ব্যবহার করতে পারবে। বিনিময়ে তারা নড়াইলে ১০০টি উন্নতমানের সিসিটিভি স্থাপনসহ সামাজিক উন্নয়নের কাজ করবে। কিন্তু সমপ্রতি আমি জানতে পেরেছি, তাদের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যে ধারণা আমাকে দেয়া হয়েছিল, তাদের ব্যবসার ধরন তা নয়। দুই বছরের চুক্তি থাকলেও দুই মাসের মধ্যেই তাদের সম্পর্কে জানার পরই আমি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইতিমধ্যেই আমি তাদেরকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছি, আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি শেষ করার আইনি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছি। আমি সবাইকে অনুরোধ করবো, আমার নাম বা ছবি দেখে বিভ্রান্ত হয়ে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে না জড়াতে।’
সংসদ সদস্য মাশরাফির এই স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে খোজ নিলে জানা যায়, গেল বছরের জানুয়ারিতে ই-কমার্সের নাম দিয়ে ব্যবসা শুরু করে এমএলএম কোম্পানি এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস। এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে রয়েছে আল আমিন প্রধান।
আল আমিন প্রধান মূলত ডেসটিনি ২০০০ এর একজন ঊর্ধ্বতন টিম লিডার এবং প্রশিক্ষক ছিলেন। তার পূর্বাভিজ্ঞতা থাকার কারণে ডেসটিনি ও যুবকের আদলেই গড়ে তুলেছেন এসপিসিকে। এমএলএম ব্যবসা ও প্রতারণার অভিযোগে গত বছরের (৩ নভেম্বর) গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন আল-আমিন প্রধানসহ তার ৬ সহযোগী।
তাদের গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার জানিয়েছিলেন, এগারো মাসে তারা ২২ লাখ ২৫ হাজার ব্যক্তিকে তাদের এই প্রতারণা ব্যবসায় যুক্ত করে হাতিয়ে নিয়েছে ২৬৮ কোটি টাকা।
তাদের ওই প্রতারণার ঘটনায় মামলা হলে আল আমিনসহ ৬জনকে বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু তারা মাত্র দু’মাসের মধ্যে জামিন পেয়ে আবারও এসপিসির কার্যক্রম শুরু করেন। এরই মধ্যে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজার সঙ্গে শুভেচ্ছা দূতের চুক্তি করেন।
এরপরেই আবার কপাল খুলথে শুরু করেএসপিসির। ‘এসপিসির সাথে রয়েছেন মাশরাফি ’ এমন প্রচারণার মাধ্যমে যুবকদের আকৃষ্ট করতে থাকেন। এরইমধ্যে তাদরে অ্যাকিউন্ট সংখ্যা ২২ লাখ থেকে ৫০ লাখে পৌছিয়েছে। গুগল প্লে স্টোর থেকেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা যায় এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস অ্যাপের ডাউনলোড সংখ্যা ৫০ লাখেরও অধিক। এই অ্যাপস ব্যবহার করে মাঠ পর্যায় থেকে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
যখন থেকে মাশরাফি বিন মর্তুজা তাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা দূতের চুক্তি বঙ্গের ঘোষণা দিয়েছে এরপর থেকেই কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়া শুরু করেছে এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস। ইতিমধ্যে তাদের বহু এজেন্ট কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় লিডাররা, এজেন্টরা এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসের এমডি ও সিইও আল-আমিন প্রধানের ফোন বন্ধ পাচ্ছেন।
এসপিসির এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসপিসি গ্রাহকদের তিন ধরনের অফার দেয়। বিজ্ঞাপন দেখে আয় করা, ই-কমার্স স্টোর থেকে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে আয় ও রেফার করার মাধ্যমে আয়। বাস্তবে তাদের কোনো পণ্যের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তরে এসপিসির বেশ কয়েকটি কোম্পানির নিবন্ধন পাওয়া গেছে। এগুলো হচ্ছে- এসপিসি রাইড লিঃ, এসপিসি কুরিয়ার অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড, এসপিসি প্রোপার্টিজ অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিঃ, এসপিসি কসমেটিক্স অ্যান্ড কেমিক্যালস লিঃ, এসপিসি ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস লিঃ, এসপিসি ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিঃ ও এসপিসি আইটি সল্যুশন লিঃ।
কিন্তু বাস্তবে খোঁজ নিয়ে এসব কোম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। মূলত রেফারেন্সের মাধ্যমে নতুন গ্রাহককে ১২০০ টাকা করে ফি দিয়ে জয়েন করানোই এসপিসির ব্যবসা। একজন গ্রাহক ১২০০ টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুললে সেই টাকা থেকে যিনি জয়েন করান তিনি ৪০০ টাকা রেফারেল বোনাস পান।
এ ছাড়া যিনি রেফারেন্স দিয়ে অন্যদের আইডি খোলাবেন তাকে জেনারেশন বোনাস নামে এমএলএম বোনাস দেয়। যেখানে প্রথম জেনারেশনে জনপ্রতি ১০০ টাকা, দ্বিতীয় জেনারেশনে জনপ্রতি ৫০ টাকা এবং তৃতীয় জেনারেশনে জনপ্রতি ১৫-২০ টাকা।
তাদের জেনারেশন পদ্ধতি হচ্ছে, একজনের নিচে তিনজন জয়েন করানো এবং সেই তিনজনের নিচে আবার তিনজন করে (মোট ৯ জন) জয়েন করালে প্রথম জেনারেশন।
এভাবে পরবর্তী ধাপে দ্বিতীয় ও তার পরবর্তী ধাপে তৃতীয় জেনারেশন হয়। এমএলএম পদ্ধতিতে কেউ এসপিসিতে ১২০০ টাকা দিয়ে আইডি খোলার পর তার অধীনে আরও তিনজনের আইডি খোলাতে পারলে তিনি হবেন ক্লাব মেম্বার।
ওই তিনজনের অধীনে আরো তিনজন করে জয়েন করাতে পারলে হবেন রয়েল মেম্বার। রয়েল মেম্বাররা প্রতিদিন কোম্পানির লভ্যাংশের ২০ শতাংশ পান।
এর পরে রয়েছে ইনসেনটিভ বোনাস নামে উচ্চ পর্যায়ের এমএলএম নেটওয়ার্ক। এখানে কোনো আইডির অধীনে তিন লাইনে ১০০ করে মোট ৩০০ আইডি খোলাতে পারলে তিনি হন এক স্টার রয়েল। এক স্টার রয়েল হলে কোম্পানির লাভের সাড়ে ১৭ শতাংশ এবং সঙ্গে সিকিম বিমান ট্যুরের প্রলোভন দেখানো হয়। তিন লাইনে ৬০০ করে মোট ১৮০০ আইডি খোলাতে পারলে ২ স্টার রয়েল। তাদের জন্য ১৫ শতাংশ শেয়ার ও নেপাল ট্যুর। তিন লাইনে ১০০০ করে মোট ৩০০০ হাজার আইডি খোলাতে পারলে ৩ স্টার রয়েল। এবার সাড়ে ১২ শতাংশ শেয়ার ও থাইল্যান্ড ট্যুরের প্রলোভন। একই ভাবে সর্বোচ্চ প্রতি লাইনে ১৫০০০ করে মোট ৪৫০০০ আইডি খোলাতে পারলে সাত স্টার রয়েছে। সাত স্টার হলে কোম্পানির আড়াই শতাংশ শেয়ার ও নগদ ২৫ লাখ টাকার প্রলোভন। একজনের অধীনে এভাবে বিপুল পরিমাণ আইডি খোলানোর নিয়মে লভ্যাংশের কথা বলা হয়েছে বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। এসপিসির বাস্তবে কোনো ব্যবসা নেই। মূলত প্রতিদিন ১২০০ টাকা করে দিয়ে যে হাজার হাজার মানুষকে আইডি খোলানো হয় সেই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয়।
এসপিসির লিডারদের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, এসপিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আল আমিন প্রধান গত বছরের নভেম্বরে গ্রেফতারের পর সিদ্ধান্ত নেন দেশে টাকা রা রাখার। বিকল্প হিসেবে বিটকয়েন ক্রয় করেন আল-আমিন প্রধান।
জানা যায়, তারা ইতিমধ্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বিটকয়েন ক্রয় করেছেন বলে দাবি করেছেন অভিযোগকারী লিডাররা। এখানে বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিয়োগ থাকার কারণে লিডাররা তাদের নাম প্রকাশে ইচ্ছুক নন।
এ ব্যাপারে এসপিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আল আমিন প্রধানের বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি ব্যস্ত আছেন এবং পরে কথা বলবেন বলে জানান।
এসপিসির একজন কর্মকর্তা জানান, গত বছরের কলাবাগান থানায় দায়ের হওয়া মামলাটি তদন্তাধীন আছে। এখন পর্যন্ত চার্জশিট হয়নি।
এ বিষয়ে ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, তার মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। তবে তারা প্রতারণার দায়ে গ্রেফতার হওয়ার পরেও কিরে তাদের আইডি ২২ লাখে থেকে ৫০ লাখে উত্তীর্ণ হলো। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবেন।