ইসলামে সৌন্দর্য

ইসলামে সৌন্দর্য, মহাপবিত্র গ্রন্থ কুরআনে জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এখানে অন্যান্য দিকের পাশাপাশি এসেছে সৌন্দর্যসংক্রান্ত আলোচনাও। যদিও বিস্তারিতভাবে কুরআনে এ নিয়ে কোনো আলোকপাত করা হয়নি, তবে বিভিন্ন বিষয় ও প্রসঙ্গের সাপেক্ষে কুরআনে সৌন্দর্যের কথা এসেছে।

যেমন, কুরআনে আলাপ করা হয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে। ইসলামে সৌন্দর্য, এটি আল্লাহর সৃষ্টি ও ক্ষমতার একটি প্রতিফলন। কুরআনে আসমান, জমিন, প্রাকৃতিক দৃশ্য, উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের কথা বলা হয়েছে।

وَ مِنۡ اٰیٰتِهٖۤ اَنۡ یُّرۡسِلَ الرِّیَاحَ مُبَشِّرٰتٍ وَّ لِیُذِیۡقَکُمۡ مِّنۡ رَّحۡمَتِهٖ وَ لِتَجۡرِیَ الۡفُلۡکُ بِاَمۡرِهٖ وَ لِتَبۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِهٖ وَ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ ﴿۴۶﴾
আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে, তিনি বাতাস প্রেরণ করেন [বৃষ্টির] সুসংবাদ বহনকারী হিসেবে এবং যাতে তিনি তোমাদেরকে তাঁর রহমত আস্বাদন করাতে পারেন এবং যাতে তাঁর নির্দেশে নৌযানগুলো চলাচল করে, আর যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ থেকে কিছু সন্ধান করতে পার। আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও। [সুরা রুম : ৪৬]

এই আয়াতে মহাবিশ্বে বিদ্যমান বিভিন্ন সৌন্দর্যের উপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহর সৃজনশীল শক্তিক্ষমতার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করাকে উৎসাহিত করা হয়েছে।

ইসলামে সৌন্দর্য ও মাধুর্য

ইসলামে সৌন্দর্য ও মাধুর্য, কুরআন আল্লাহকে সকল সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতার উৎস হিসেবে বর্ণনা করেছে। আল্লাহকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতার গুণাবলী সহ বর্ণনা করা হয়েছে, যেমন আল-জামীল (সুন্দর), আল-আদল (ন্যায়পরায়ণ) এবং আল-কারিম (উদার)। এই বৈশিষ্ট্যগুলো সৌন্দর্যের ঐশ্বরিক সারমর্মকে তুলে ধরে এবং আল্লাহর ঐশ্বরিক গুণাবলীর প্রতিফলন হিসাবে সৌন্দর্যকে স্বীকৃতি ও প্রশংসা করার গুরুত্বের উপর জোর দেয়।

কুরআন বাহ্যিক চেহারার চেয়ে অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য এবং চরিত্রের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছে বেশী।ইসলামে সৌন্দর্য,  কুরআন মুমিনদেরকে উদারতা, ধৈর্য এবং ধার্মিকতার মতো গুণাবলী গড়ে তুলতে উৎসাহিত করে। সুরা আল-হুজুরাতে (49:13) বলা হয়েছে যে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত তারাই যারা সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ ذَکَرٍ وَّ اُنۡثٰی وَ جَعَلۡنٰکُمۡ شُعُوۡبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوۡا ؕ اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰهِ اَتۡقٰکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ ﴿۱۳﴾
হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত। [সুরা হুজুরাত : ১৩]

এটি অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের তাৎপর্য এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যকে তুলে ধরে।
সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন সৃষ্টি যেমন গাছপালা, ফলমূল, ফসল, উদ্ভিদ –ইত্যাদি প্রতিটি জিনিস সৃষ্টির পেছনে মহান আল্লাহ তাআলার অসীম প্রজ্ঞার নিদর্শন আছে। এগুলোর ভেতর কেবল সৌন্দর্যই লুকায়িত নেই, প্রচুর উপকারিতাও আছে সবকিছুর যা হতো সর্বদা আমাদের চোখে স্পষ্টরূপে ধরা দেয় না। এই জিনিসগুলো খাদ্য হিসেবে কাজ তো করে বটেই। এর পাশাপাশি এগুলো মানবহৃদয়কে প্রফুল্ল করে। ফুলের থোকা দেখলে আমাদের নয়ন জুড়িয়ে যায়, তাজা ফল দেখতে ভালো লাগে। আমরা এসব উপাদানের দ্বারা নিজেদের ভেতর প্রাণোচ্ছলতা অনুভব করি।

اَمَّنۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ اَنۡزَلَ لَکُمۡ مِّنَ السَّمَآءِ مَآءً ۚ فَاَنۡۢبَتۡنَا بِهٖ حَدَآئِقَ ذَاتَ بَهۡجَۃٍ ۚ مَا کَانَ لَکُمۡ اَنۡ تُنۡۢبِتُوۡا شَجَرَهَا ؕ ءَ اِلٰهٌ مَّعَ اللّٰهِ ؕ بَلۡ هُمۡ قَوۡمٌ یَّعۡدِلُوۡنَ ﴿ؕ۶۰﴾
বরং তিনি (শ্রেষ্ঠ), যিনি আসমানসমূহ ও যমীনকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জন্য তিনি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর তা দ্বারা আমি মনোরম উদ্যান সৃষ্টি করি। তার বৃক্ষাদি উৎপন্ন করার ক্ষমতা তোমাদের নেই।ইসলামে সৌন্দর্য,  আল্লাহর সাথে কি অন্য কোন ইলাহ আছে? বরং তারা এমন এক কওম যারা শিরক করে। [সুরা নামল : ৬০]

ইসলামে সৌন্দর্য ও রুচিবোধ

ইসলামে সৌন্দর্য ও রুচিবোধ, আকাশকে এত উঁচু ও সুন্দর করে সৃষ্টিকারী ও চলমান গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টিকারী অনুরূপ পৃথিবী ও তার মাঝে পাহাড়, নদ-নদী, সমুদ্র, গাছ-পালা, ফল-ফসল, নানা প্রকারের পশু-পক্ষী সৃষ্টিকারী, আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করে সুন্দর বাগান উৎপাদনকারী কে? এ সব কিছুর কর্তা একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ নিজে সুন্দর।ইসলামে সৌন্দর্য ও রুচিবোধ,  তিনি নিজেও সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন।ইসলামে সৌন্দর্য,  তিনি চান তার সৃষ্টিও তার পছন্দ-ভালোবাসাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করুক। যে আল্লাহর সৌন্দর্যের নীতি মেনে চলবে তা-ই হল প্রকৃত সৌন্দর্যতত্ত্ব।

আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। [ইবনু হিব্বান : ৫৪৬৬]

পবিত্র কুরআনুল কারিমে অনেক জায়গায় বৃক্ষরাজি, উদ্ভিদ, ফল ও বাগানের কথা বারবার এসেছে যা কখনোই দৃষ্টিঅগ্রাহ্য হতে পারে না। যেমন: আল-কুরআনে শাজার (গাছ) শব্দটি তার বুৎপন্ন শব্দসহ ছাব্বিশবার এসেছে; সামার (ফল) শব্দটি তার তার থেকে বুৎপন্ন শব্দসহ এসেছে বাইশ বার; নাবাত (তৃণ ও উদ্ভিদ) শব্দটি তার থেকে ব্যুৎপন্ন শব্দসহ এসেছে ছাব্বিশবার; হাদিকাহ (বাগান) শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে তিনবার; জান্নাত (উদ্যান শব্দটি একবচন ও বহুবচনসহ এসেছে ১৩৮ বার।)
কুরআনে গাছ ও ফলের প্রসঙ্গ যতবার এসেছে আল্লাহ সৌন্দর্যের কথাও তার সাথে ততবার জুড়ে দিয়েছেন।

فَلۡیَنۡظُرِ الۡاِنۡسَانُ اِلٰی طَعَامِهٖۤ ﴿ۙ۲۴﴾ اَنَّا صَبَبۡنَا الۡمَآءَ صَبًّا ﴿ۙ۲۵﴾ ثُمَّ شَقَقۡنَا الۡاَرۡضَ شَقًّا ﴿ۙ۲۶﴾ فَاَنۡۢبَتۡنَا فِیۡهَا حَبًّا ﴿ۙ۲۷﴾ وَّ عِنَبًا وَّ قَضۡبًا ﴿ۙ۲۸﴾ وَّ زَیۡتُوۡنًا وَّ نَخۡلًا ﴿ۙ۲۹﴾ وَّ حَدَآئِقَ غُلۡبًا ﴿ۙ۳۰﴾ وَّ فَاکِهَۃً وَّ اَبًّا ﴿ۙ۳۱﴾ مَّتَاعًا لَّکُمۡ وَ لِاَنۡعَامِکُمۡ ﴿ؕ۳۲﴾
কাজেই মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। নিশ্চয় আমি প্রচুর পরিমাণে পানি বর্ষণ করি। তারপর যমীনকে যথাযথভাবে বিদীর্ণ করি। অতঃপর তাতে আমি উৎপন্ন করি শস্য, আঙ্গুর ও শাক-সবজি, যায়তূন ও খেজুর বন, ঘনবৃক্ষ শোভিত বাগ-বাগিচা, আর ফল ও তৃণগুল্ম। তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুগুলোর জীবনোপকরণস্বরূপ। [সুরা আবাসা : ২৪-৩২]

এটাই আমাদের ইসলামে সৌন্দর্য

বৃক্ষরাজিশোভিত ও ফলরাশিপূর্ণ উদ্যান সৃষ্টির পেছনে রয়েছে মহান আল্লাহর নন্দনতাত্ত্বিক প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মহান আল্লাহর নানা সৃষ্টিতে। এটাই আমাদের ইসলামে সৌন্দর্য, এ ছাড়া কুরআন ও সুন্নাহয় জান্নাত বা বাগানের যে চিত্রায়ণ করা হয়েছে সেখানে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এমন অসংখ্য জিনিসের যা মানুষের মানসিক সুখ নিশ্চিত করবে, ইন্দ্রিয়কে তৃপ্ত করবে।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, জান্নাত সম্পর্কে আমাদের কাছে বর্ণনা করুন, তার নির্মাণ কি দিয়ে? তিনি বললেন, জান্নাতের একটি ইট রুপার, আরেকটি ইট সোনার। তার প্রলেপ (প্লাস্টার) সুরভিত মিসকের। মুক্তা ও পদ্মরাগ হল তার কঙ্কর। তার মাটি হল জাফরান। যে ব্যক্তি সেখানে প্রবেশ করবে সে সুখে ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে, কখনো কষ্ট পাবে না। সে সেখানে হবে চিরঞ্জীব, কখনো তার মৃত্যু হবে না। তার পোশাক জীর্ণ হবে না, কখনো ফুরাবে না তার যৌবনকাল। [মুসনাদু আহমাদ : ৮০৩০]

আবদুল্লাহ ইবনু কায়স রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
الْخَيْمَةُ دُرَّةٌ مُجَوَّفَةٌ طُوْلُهَا فِي السَّمَاءِ ثَلَاثُوْنَ مِيْلًا فِيْ كُلِّ زَاوِيَةٍ مِنْهَا لِلْمُؤْمِنِ أَهْلٌ لَا يَرَاهُمْ الْآخَرُوْنَ قَالَ أَبُوْ عَبْدِ الصَّمَدِ وَالْحَارِثُ بْنُ عُبَيْدٍ عَنْ أَبِيْ عِمْرَانَ سِتُّوْنَ مِيْلًا
জান্নাতের মধ্যে ফাঁপা মোতির একটি তাঁবু থাকবে। এর প্রশস্ততা হবে ষাট মাইল। এর প্রতি কোণে থাকবে হুর-বালা। এদের এক কোণের জন অপর কোণের জনকে দেখতে পাবে না। ইমানদার লোকেরা তাদের কাছে যাবে। এতে থাকবে দুটি বাগান, যার সকল পাত্র এবং ভেতরের সকল বস্তু হবে রূপার তৈরী। [সহিহ বুখারি : ৩২৪৩]

আনাস ইবনু মালিক রা. সূত্রে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন,
بَيْنَمَا أَنَا أَسِيرُ فِي الْجَنَّةِ إِذَا أَنَا بِنَهَرٍ حَافَتَاهُ قِبَابُ الدُّرِّ الْمُجَوَّفِ قُلْتُ مَا هَذَا يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَذَا الْكَوْثَرُ الَّذِي أَعْطَاكَ رَبُّكَ فَإِذَا طِينُهُ أَوْ طِيبُهُ مِسْكٌ أَذْفَرُ شَكَّ هُدْبَةُ
আমি জান্নাতে ভ্রমণ করছিলাম, এমন সময় এক ঝর্ণার কাছে এলে দেখি যে তার দু’ধারে ফাঁপা মুক্তার গম্বুজ রয়েছে। আমি বললাম, হে জিবরিল! এটা কী? তিনি বললেন, এটা ঐ কাউসার যা আপনার প্রতিপালক আপনাকে দান করেছেন। তার ঘ্রাণে অথবা মাটিতে ছিল উত্তম মানের মিশক এর সুগন্ধি। [সহিহ বুখারি : ৬৫৮১]

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
নিশ্চয় জান্নাতে এত বড় গাছ থাকবে, অশ্বারোহী তার ছায়ায় একশ বছর ভ্রমণ করেও তা অতিক্রম করতে পারবে না। [সহিহ বুখারি : ২৮২৭]

নান্দনিকতা ও সৌন্দর্যের এমন অপার্থিব বিবরণ কুরআন ও সুন্নাহয় এরকমভাবে আরো অনেক জায়গায় এসেছে। ইসলামে সৌন্দর্য তাই মুসলিমরাও কুরআন ও সুন্নাহর উপর্যুক্ত অনন্য চিত্র অনুসরণ করে মানবসভ্যতাকে দিয়েছেন নানা উপহার।

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *