আল্লাহর উপর তাঁদের তাওয়াক্কুল

আল্লাহর উপর তাঁদের তাওয়াক্কুল। আমাদের জীবনে আছে নানা অনিশ্চয়তা ও চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ মুমিনদের কাবু করতে পারে না। কারণ যুগ যুগ ধরে মুমিনদের প্রেরণার বাতিঘর হয়ে কাজ করেছে তাওয়াক্কুল। তাওয়াক্কুল হল আল্লাহর পরিকল্পনার প্রতি নিজেকে সম্পূর্ণ নত করে দেওয়া। আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর হওয়া। 

আল্লাহর উপর তাঁদের তাওয়াক্কুল

আল্লাহর উপর তাঁদের তাওয়াক্কুল, তাওয়াক্কুল আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো, ভরসা করা, নির্ভর করা। তাওয়াক্কুল শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ “ওয়াকালা” থেকে। তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ অর্থ হলো: আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করা। ইসলামে আল্লাহ তাআলার ওপর তাওয়াক্কুল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি একটি ইবাদত। আল্লাহর উপর তাঁদের তাওয়াক্কুল, তাই আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কারো ওপর তাওয়াক্কুল করা যায় না। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য তাওয়াক্কুল নিবেদন করা যাবে না। মৃত বা জীবিত কোনো ওলি, নবি-রাসূল, পীর-বুযুর্গের ওপর ভরসা করা বা তাওয়াক্কুল রাখা শির্ক।

তাওয়াক্কুল হল ইসলামি বিশ্বাসের একটি ভিত্তি, যা মুমিনদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার হাতে। তাওয়াক্কুল হল আল্লাহর প্রজ্ঞা ও অসীম করুণার প্রতি অবিচল আস্থা। 

আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

﴿وَلَمَّا رَءَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلۡأَحۡزَابَ قَالُواْ هَٰذَا مَا وَعَدَنَا ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَصَدَقَ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥۚ وَمَا زَادَهُمۡ إِلَّآ إِيمَٰنٗا وَتَسۡلِيمٗا ٢٢﴾ [الاحزاب: ٢٢]

‘‘আর মুমিনগণ যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখল তখন তারা বলল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল আমাদের যে ওয়াদা দিয়েছেন এটি তো তাই। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সত্যই বলেছেন’। এতে তাদের ইমান ও ইসলামই বৃদ্ধি পেল।’’ [সুরা আল-আহজাব, আয়াত: ২২]

﴿ٱلَّذِينَ قَالَ لَهُمُ ٱلنَّاسُ إِنَّ ٱلنَّاسَ قَدۡ جَمَعُواْ لَكُمۡ فَٱخۡشَوۡهُمۡ فَزَادَهُمۡ إِيمَٰنٗا وَقَالُواْ حَسۡبُنَا ٱللَّهُ وَنِعۡمَ ٱلۡوَكِيلُ ١٧٣ فَٱنقَلَبُواْ بِنِعۡمَةٖ مِّنَ ٱللَّهِ وَفَضۡلٖ لَّمۡ يَمۡسَسۡهُمۡ سُوٓءٞ وَٱتَّبَعُواْ رِضۡوَٰنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ ذُو فَضۡلٍ عَظِيمٍ ١٧٤﴾ [ال عمران: ١٧٣، ١٧٤]

‘‘যাদেরকে মানুষেরা বলেছিল যে, ‘নিশ্চয় লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে একত্র হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ভয় কর’। কিন্তু তা তাদের ইমান বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক’! অতঃপর তারা ফিরে এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিআমত ও অনুগ্রহসহ। কোনো মন্দ তাদেরকে স্পর্শ করে নি এবং তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করেছিল। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।’’ [সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৭৩-১৭৪]

﴿وَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱلۡحَيِّ ٱلَّذِي لَا يَمُوتُ﴾ [الفرقان: ٥٧]

‘‘আর তুমি ভরসা কর এমন চিরঞ্জীব সত্তার ওপর যিনি মরবেন না।’’ [সুরা আল ফুরকান, আয়াত: ৫৮]

সালাফরা আমাদের অনুসরণীয় আদর্শ। সাহাবিদের প্রজন্মের পর তারাই শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম। তারা তাদের জীবনের পথকে তাওয়াক্কুলের উজ্জ্বল আলোয় প্রজ্জ্বলন করেছিলেন। তাদের জীবনে আছে আল্লাহর প্রতি অবিচলতার অসংখ্য গল্প। 

এই লেখায় আমরা তাওয়াক্কুলের গভীরে ঢুকব, সালাফদের জীবনে তাওয়াক্কুলের প্রতিফলন ও তাৎপর্য দেখব। আল্লাহর উপর তাঁদের তাওয়াক্কুল, আমরা বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক ঘটনা পড়ব যেসব গল্পে উঠে আসবে আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস, প্রতিকূলতার মধ্যেও দৃঢ় থাকা এবং আল্লাহর পরিকল্পনার প্রতি অটুট বিশ্বাসের প্রতিফলন। গল্পগুলো কাজ করবে আমাদের জন্য রিমাইন্ডার হিসেবে। আমাদের নিজেদের জীবনে তাওয়াক্কুলের চর্চা তৈরী করতে অনুপ্রাণিত করবে। দুনিয়াবি জীবনে এনে দেবে স্বস্তির পরশ।

আসুন আমরা আমাদের এই যাত্রা শুরু করি। তাওয়াক্কুলের জীবন বদলে দেওয়ার ক্ষমতার প্রতি আমাদের হৃদয় ও মনকে উন্মোচন করি। এসব গল্পগুলো আল্লাহর প্রতি আমাদের ভরসাকে মজবুত করতে অনুপ্রাণিত করবে, তার প্রজ্ঞা ও হিদায়াতের পথে টিকে থাকার অনুপ্রেরণা যোগাবে, আমাদের মধ্যে আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা ও আত্মসমর্পণের দৃঢ় বন্ধন তৈরী করবে। অথবা তাওয়াক্কুলের আলিঙ্গনেই আমরা প্রশান্তি, উদ্দেশ্য এবং ইমানের প্রকৃত অভিব্যক্তি খুঁজে পাই।

প্রথম গল্প: ইমাম মালিক রাহ. ও বিচ্ছুর গল্প

ইমাম মালিক ইবনু আনাস রাহ. একজন প্রখ্যাত ফকিহ ও আলিম। আল্লাহর ওপর গভীর নির্ভরতার জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন। বর্ণিত আছে যে, একবার তিনি শিক্ষারত অবস্থায় একটি বিচ্ছু তাকে দংশন করে। ব্যথা সত্ত্বেও, ইমাম মালিক শান্ত ছিলেন। কামড়ের প্রতি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে তিনি পড়ানো চালিয়ে যান। আল্লাহর উপর তাঁদের তাওয়াক্কুল, যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, “আপনি বিচ্ছুটিকে তাড়ালেন না কেন?” তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আল্লাহ যদি আমার ক্ষতি করতে চান তবে কেউ বাধা দিতে পারত না। আর আল্লাহ আমার ক্ষতি করতে না চাইলে এই বিচ্ছুটি আমাকে কামড়াতে পারত না।”

দ্বিতীয় গল্প: উম্মু সালামাহ রা. ও ভাঙ্গা নেকলেসের গল্প

উম্মু সালামাহ রা. রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রী। তাওয়াক্কুলের চমৎকার উদাহরণ রেখে গিয়েছেন তিনি। একবার তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। হঠাৎ তিনি খেয়াল করেন তার নেকলেস হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। উম্মু সালামাহ নেকলেস খুঁজে পেতে যে পথ দিয়ে এসেছিলেন সেই পথেই ফিরে গেলেন। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি ক্যাম্পে ফিরে এলেন। আল্লাহর উপর তাঁদের তাওয়াক্কুল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘটনাটা জেনে উম্মু সালামাহ রা.-কে স্বান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “হে উম্মু সালামাহ, তুমি কি জানো না যে আল্লাহ তোমার থেকে কোনো কিছু নিয়ে গেলে সেটাই তোমার জন্য উত্তম?” উম্মু সালামাহ এই রিমাইন্ডার মেনে নিলেন। বুঝতে পারলেন, যে কোনো হারানো বস্তুর চেয়ে আল্লাহর প্রজ্ঞা ও সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা করা অধিক মূল্যবান।

তৃতীয় গল্প: জুনায়েদ বাগদাদি ও ক্ষুধার্ত সিংহের গল্প

জুনায়েদ বাগদাদি রাহ. এক বিখ্যাত সুফি। তিনিও তাওয়াক্কুলের জন্য পরিচিত চিলেন। একবার তিনি ভ্রমণ করছিলেন। এসময় তার সামনে ক্ষুধার্ত সিংহ চলে এল। অন্যরা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু জুনায়েদ শান্ত থাকলেন। পড়লেন, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ – আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি বা ক্ষমতা নেই। সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখল, সিংহটি জুনায়েদের দিকে শান্তভাবে এগিয়ে এল এবং তার মাথা জুনায়েদের পায়ে ঘষতে লাগল। জুনায়েদ সিংহটির দিকে ফিরে বললেন, “হে সিংহ! আমি কি তোমাকে বলিনি যে আমার সব সমস্ত সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা, আর আমি তার নিরাপত্তাধীন?” 

এই ঘটনায় জুনায়েদ রাহ.-এর অটল বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুলের পরিচয় পাওয়া যায়। কারণ তিনি জানতেন, আল্লাহর ক্ষমতা সিংহসহ দুনিয়ার সকল সৃষ্টির ওপর প্রসারিত।

চতুর্থ গল্প: আবু দারদা রা. এবং তার বাগানের ঘটনা

আবু দারদা রা. তাঁর ইলম ও ধার্মিকতার জন্য পরিচিত এক সাহাবি ছিলেন। তিনি একটি সুন্দর বাগানের মালিক ছিলেন। বাগানে প্রচুর ফলমূল হতো। একদিন খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. আবু দারদাকে দেখতে গেলেন এবং বাগানটাও দেখলেন। মুগ্ধ হয়ে উমর আবু দারদাকে জিজ্ঞেস করলেন কিভাবে তিনি এমন অসাধারণ বাগান গড়ে তুলেছেন। উত্তরে আবু দারদা বললেন, আমি আল্লাহকে আমার ভরসা বানিয়েছি এবং একমাত্র তাঁরই উপর ভরসা করেছি। আবু দারদার এই জবাব আবু দারদার আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসকে তুলে ধরে। তিনি জানেন, তার সাফল্য শুধুমাত্র আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল।

পঞ্চম গল্প: উওয়াইস আল-কারনি রা. এবং তাঁর মায়ের ঘটনা

উওয়াইস আল-কারনি ছিলেন নবি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর একজন সাহাবী।আল্লাহর উপর তাঁদের তাওয়াক্কুল,  তিনি ধার্মিকতা ও তাকওয়ার জন্য পরিচিত ছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় ছিলেন তখন তিনি ছিলেন ইয়ামেনে। উওয়াইসের মা অসুস্থ ছিলেন। তিনি যত্ন সহকারে মায়ের দেখাশোনা করতেন। 

একবার নবিজি উওয়াইসকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মা কেমন আছেন? 

উওয়াইস উত্তরে বললেন, তিনি অসুস্থ। 

নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন জিজ্ঞাসা করলেন, উওয়াইস কি তার মায়ের কাপড় এনে তার গায়ে (রাসুলের) ঘষতে পারবে কী না। উওয়াইস নির্দেশমতো কাজ করলেন। যখন উওয়াইস বাড়ি ফিরে গেলেন দেখলেন তার মা সম্পূর্ণ সুস্থ। 

ষষ্ঠ গল্প: আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক রাহ. ও তাঁর ঘোড়া

আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাক ছিলেন এক বিখ্যাত আলিম। তাঁর সময়কার নেককার বান্দাদের একজন। একবার তিনি একটি ঘোড়া কিনে এরপর সেটা বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আল্লাহর উপর তাঁদের তাওয়াক্কুল, যখন তাকে বিক্রি করার কারণ জিজ্ঞেস করা হল, তিনি জবাব দিলেন, “আমার মনে হল, আমি আল্লাহর বদলে ঘোড়ার ওপর তাওয়াককুল করছিলাম।”

এবার নিজেকে নিয়ে ভাবি, আসলেই কি আমরা আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল করতে পারছি?

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *