আমেরিকার স্বপ্নের বাড়ি কিনতে হলে যা করতে হবে

অধিকাংশ মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় আর্থিক সিদ্ধান্ত বাড়ি কেনার সময়ে নিতে হয়। অভিবাসীরা আমেরিকায় এসে স্বাভাবিকভাবেই নিজের একটি বাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখেন। বাংলাদেশিরাও স্বপ্নপূরণের তালিকার শুরুতেই রাখে বাড়ি কেনার বিষয়টিকে।

আমেরিকার অন্যান্য অঙ্গরাজ্যগুলোর তুলনায় নিউইয়র্কে বাড়ি কেনা ব্যয়বহুল এবং এ জন্য প্রয়োজন হয় সঠিক পরিকল্পনার। নিউইয়র্ক সিটিতে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যবিমার সহজলভ্যতা ও বাসা ভাড়ার ব্যাপক চাহিদার কারণে বাড়ির দাম বেড়েই চলেছে। অভিবাসীরাও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় প্রথম পছন্দের তালিকায় নিউইয়র্ক সিটিকেই রাখে। কিন্তু ক্রমাগত দাম বৃদ্ধির কারণে এ শহরে বাড়ি কিনতে থাকা প্রয়োজন পূর্বপ্রস্তুতি ও আর্থিক সংগতি। বাড়ি ক্রয়ের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াটি তাই সবার জানা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ধারণা না থাকলে অনেক সময় প্রতারণার স্বীকার হতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় রিয়েল এস্টেট এজেন্ট/ব্রোকার, মর্টগেজ ব্রোকার, উভয় পক্ষের অ্যাটর্নিসহ বিভিন্ন লোক জড়িত থাকে। এসব প্রক্রিয়া না জানায় অনেকে আর্থিক ক্ষতি কিংবা হয়রানির স্বীকার হন। তাই বাড়ি কেনার সময় অন্তত ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে ।

রিয়েল এস্টেট এজেন্ট/ব্রোকার নিয়োগ দিন :
রিয়েল এস্টেট এজেন্ট/ব্রোকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে সনদপ্রাপ্ত এবং তাদের কার্যক্রম আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অনেকে মনে করেন, শুধু বাড়ি বিক্রি করতে এজেন্ট/ব্রোকারের প্রয়োজন। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। বাড়ি কিনতেও এজেন্ট নিয়োগ করা অত্যাবশ্যক, যিনি আপনার প্রতিনিধিত্ব করবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি যে ছয়টি বিষয় মেনে চলবেন, তা হলো ক) কর্তব্যপরায়ণতা, খ) আনুগত্য, গ) দৃষ্টিগোচর করানো, ঘ) গোপনীয়তা রক্ষা, ঙ) দায়িত্ববোধ ও চ) যুক্তিসংগত যত্ন। ক্রেতা হিসেবে যদি বিক্রেতার এজেন্টের মাধ্যমে বাড়ি কেনেন, তাহলে ওই এজেন্ট আপনার প্রতি এসব দায়িত্ব পালনে আইনগতভাবে বাধ্য থাকবেন না। আপনির বিক্রেতার এজেন্ট কাছে হবেন কাস্টমার এবং বিক্রেতা হবেন ক্লায়েন্ট। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতার এজেন্ট আপনার প্রতিনিধিত্ব করছেন না এবং ব্যাপারটি হবে অ্যাটর্নি ছাড়াই আদালতে যাওয়া। তাই শুরুতেই এজেন্ট নিয়োগ দিন।

বাড়ির ঋণের জন্য প্রাক-অনুমোদন সংগ্রহ করুন :
বাড়ি কেনার জন্য আপনার আর্থিক সক্ষমতা প্রধান বিবেচ্য বিষয়। আপনার প্রদর্শিত আয়ের ওপর নির্ভর করে ব্যাংক আপনাকে ঋণ দেবে। এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান নিয়ামক হলো আপনার ক্রেডিট স্কোর। রিয়েল এস্টেট এজেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় বাড়ির দাম, ট্যাক্স, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল, ইনস্যুরেন্স ইত্যাদি সম্পর্কে একটি ধারণা নিন। এটি বাজেট তৈরিতে সহায়তা করবে। মাল্টি ফ্যামিলির ক্ষেত্রে প্রাপ্ত ভাড়া আপনার আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের ঋণ প্রকল্প রয়েছে। উপযুক্ত ঋণ প্রকল্পটি গ্রহণ করুন। প্রথমবার বাড়ি কেনার সময় মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমে আপনি ঋণ পেতে পারেন। মিলিটারি কিংবা ভেটেরান স্ট্যাটাসসহ ব্যক্তি শূন্য ডাউন পেমেন্টে বাড়ি কিনতে পারবেন। বাড়ি দেখার আগেই প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্টের টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রাখুন। এতে বাড়ি কেনার প্রক্রিয়া সাবলীল ও দ্রুত হবে।

বাড়ি খুঁজুন ও নির্বাচন করুন :
এজেন্ট নিয়োগ দিলে তিনিই আপনাকে আপনার চাহিদা অনুযায়ী বাড়ি দেখাবেন। অন্যথায় আপনার চাহিদা অনুযায়ী এলাকা পছন্দ করুন ও বাড়ি খুঁজুন। বাড়ি নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্কুল ডিস্ট্রিক্ট, জোনিং, যোগাযোগের সুবিধা ইত্যাদি মাথায় রাখুন। জোনিং অনুযায়ী সিঙ্গেল ফ্যামিলি অথবা মাল্টি ফ্যামিলি বাড়ি খুঁজতে পারেন। নিউইয়র্ক সিটিতে প্রধানত ব্রিক অথবা ফ্রেমের বাড়ি অ্যাটাচ্‌ড, সেমি অ্যাটাচ্‌ড ও ডিটাচ হয়ে থাকে। বাড়ি পছন্দ হলে সিটির আইনের কোনো ভায়োলেশন কিংবা কোনো উন্নয়নকাজ অথবা পরিবর্তন করা হলে, তাতে ভবন বিভাগের অনুমোদন রয়েছে কিনা; কিংবা অভিযোগ আছে কিনা—তা খোঁজ করুন। এ ব্যাপারে এজেন্ট আপনাকে সহযোগিতা করতে পারে। আপনার প্রয়োজনীয়সংখ্যক বেডরুম, বাথরুম, ডাইনিং, ড্রয়িং ইত্যাদি জেনে নিন। বাড়ির সার্টিফিকেট অব অকুপেন্সি বা দখলাধিকার যাচাই করুন। নিউইয়র্ক সিটিতে ১৯৩৮ সালের পর নির্মিত সব বাড়ির সার্টিফিকেট অব অকুপেন্সি বা দখলাধিকার থাকা বাধ্যতামূলক। আপনি বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে নিজেও দেখে নিতে পারেন বিষয়টি।

বাড়ির দাম প্রস্তাব করুন :
পছন্দমতো বাড়ি খুঁজে পেলে এর দাম বলার আগে বাজার যাচাই করুন। নিউইয়র্ক সিটির বাড়ির দাম নির্ধারিত হয় মূলত বাড়ির আকার, যোগাযোগের সুবিধা, বাড়ির প্রকৃত অবস্থা, স্কুল ডিস্ট্রিক্ট, ম্যানহাটন থেকে দূরত্ব ও ভৌগোলিক এলাকার ওপর ভিত্তি করে। কিছু কিছু ফ্রি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বাড়ির দাম সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন। কিন্তু তার ওপর পুরো নির্ভর করা যাবে না। কারণ, সেগুলো সারা আমেরিকার তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে, যা নিউইয়র্ক সিটির ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। এ ক্ষেত্রে Comps Inc, Geo Data, Property Shark ইত্যাদির মাধ্যমে সর্বশেষ ৩-৬ মাসের মধ্যে বিক্রীত সম আকৃতির ও শুধুমাত্র বিক্রীত বাড়ির তুলনামূলক দাম দেখে দাম নির্ধারণ করতে পারেন। দাম নির্ধারণে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট আপনাকে সহযোগিতা করবে। আপনি নিজে দাম প্রস্তাব করুন লিখিতভাবে। এজেন্টকে বলুন প্রস্তাবটি যেন রেজিস্ট্রি করে বিক্রেতার এজেন্টের কাছে পাঠায়। অনেক ক্ষেত্রে আপনার এজেন্ট অন্য এজেন্টের উপস্থিতিতে বিক্রেতার কাছে প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারে। আপনার দরাদরি করা সুযোগ রয়েছে। মনে রাখবেন প্রস্তাব গ্রহণের সময় বিক্রেতা ও তাঁর এজেন্ট Fair Housing Guideline ও Equal Housing Opportunity অবশ্যই মেনে চলবেন। কোনো রকম বৈষম্য করতে পারবেন না। প্রস্তাবের সময় অবশ্যই আপনার ঋণের প্রাক-অনুমোদন ও প্রুফ অব ফান্ডের কপি প্রদান করুন।

বাড়ি ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিন :
আপনার আর্থিক প্রস্তাব গৃহীত হলে চুক্তিপত্র সম্পাদনের আগে অবশ্যই বাড়ি ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিন। সিঙ্গেল ফ্যামিলির বাড়ির ক্ষেত্রে ৪৫০ ডলার ও মাল্টি ফ্যামিলির বাড়ির ক্ষেত্রে ৮০০ ডলার খরচ হতে পারে। বাড়ির গ্যাস, পানি, সুয়ারেজ, ব্রয়লার, হিটিং সিস্টেম, ছাদ, ইলেকট্রিক সিস্টেম প্রভৃতি ভালোভাবে পরীক্ষা করে নেবেন। মনে রাখবেন, চুক্তিপত্র সম্পাদনের পর As is clause-এর কারণে বাড়ি যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থাতেই আপনাকে বাড়ি নিতে হবে। তাই আগেই পরীক্ষা করুন। নিউইয়র্ক সিটির জন্য Termite Inspection বাধ্যতামূলক এবং ক্লোজিং অবশ্যই দেখাতে হবে। Lead based paint disclosure form-এ অবশ্যই অপর পক্ষকে স্বাক্ষর করতে হবে। কোনো কিছু নিয়ে সন্দেহ হলে আপনার এজেন্টের পরামর্শ নিন। ক্রেতা হিসেবে আপনি আপনার অ্যাটর্নি নিয়োগ করুন। যদি বাড়িতে কোনো কাজ কিংবা পরিবর্তন দরকার হয়, তাহলে তা অবশ্যই চুক্তিপত্রে উল্লেখ করবেন। বিক্রেতা কর্তৃক পাঠানো চুক্তিপত্র আপনার অ্যাটর্নির মাধ্যমে স্বাক্ষর করে ফেরত পাঠাবেন। বিক্রেতা এতে স্বাক্ষর করলে আপনার চুক্তিপত্র পূর্ণমাত্রায় কার্যকর হবে।

বাড়ির ক্লোজিং করুন এবং দখল বুঝে নিন :
চুক্তিপত্র সম্পাদনের পর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের অনুমোদনরে জন্য জমা করুন। একটি তালিকা তৈরি করে সব নথি একসঙ্গে দিলে ঋণ প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়। ব্যাংক বাড়ির মূল্য তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নির্ধারণ করবে। সাধারণত ৩০ দিনের মধ্যে ব্যাংকঋণের অঙ্গীকারনামা দেওয়া হয় এবং ৪৫ দিনের মধ্যে বাড়ির ক্লোজিং হয়। ক্লোজিংয়ের আগে বাড়ি আরেকবার পরিদর্শন করুন এবং আগের মতো সব ঠিক আছে কিনা, সে বিষয়ে অ্যাটর্নিকে অবহিত করুন। ক্লোজিংয়ের আগে ব্যাংক আপনাকে Closing Disclosure অবশ্যই দেবে। এর আগেই আপনার অ্যাটর্নিকে টাইটেল সার্চ করতে বলুন। ক্লোজিংয়ের দিন আপনার কী পরিমাণ নগদ ডলার লাগবে, তা অ্যাটর্নির মাধ্যমে জেনে নিন এবং ব্যাংক চেক অথবা পে-অর্ডারের মাধ্যমে অর্থ নিয়ে যান। মনে রাখবেন দু কপি ফটো আইডি সঙ্গে রাখবেন। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বাড়ির চাবি বুঝে নিন এবং নিশ্চিন্তে নিজের বাড়িতে বসবাস শুরু করুন।

Leave a Comment