আমার অপ্সরী

“মাম্মাম, বাপী কবে আসবে? আমার ড্রয়ারটাতো ভর্তি হয়ে গেল চিঠিতে। বাপী কবে আমার সব চিঠি পড়বে?”__সূহা আমার মধ্যমা আঙ্গুল আলতো হাতে ধরে নাড়া দিচ্ছিল। যেমনিভাবে বাচ্চারা কিছু একটার বাহানা করে।

আমি শেষ বিকেলের আকাশটা দেখছিলাম। মৃদুমন্দ বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছিলো আমায়। নীলিমার সব রং ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আকাশে রাজত্ব করছে শুধুই ধূসর মেঘ। আকাশ তার মোহনীয় রুপে মেঘেদের সাজিয়ে রেখেছে। মনে হচ্ছে, গগন-হৃদয়ে বারীশের আবির্ভাব শুরু হবে খানিক পরেই।

হোক না শুরু ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। কতদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। শেষবার আয়ানের সাথে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম, সেই কয়েক বছর আগে। বৃষ্টি আয়ানের খুব পছন্দের ছিল। বৃষ্টি হলেই সে পাগলের মতো আমাকে নিয়ে ছাদে ছুটে যেত। আমি যত ব্যস্ততায় থাকি না কেন! বৃষ্টি হলে সে এসব কিছু বুঝতে চাইতো না। আমাকে বলতো, “তুমি কি জানো? বৃষ্টিতে ভেজা সুন্নাত। বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দু’আ করলেও দু’আ কবুল হয়। ও বৃষ্টির পানি হাতে নিয়ে দুয়া করতো। তার খুব ইচ্ছে ছিল আমাদের প্রথম বাচ্চাটা যেন মেয়ে হয়। বৃষ্টির পানি স্পর্শ করে সে একাধিকবার এই দু’আ করেছিল।

আল্লাহ্ তা’য়ালা তার দু’আ কবুল করেছিলেন। কিন্তু সেই মেয়ে দেখার সৌভাগ্যও তার হয়নি। সে কত স্বপ্ন দেখতো তার মেয়েকে নিয়ে। মেয়েকে নাকি আমার চেয়েও বেশি ভালবাসবে। আমাকে আশ্বস্ত করে সে বলতো, “মেয়ের সবকাজ আমিই করবো কিন্তু! ভাতটাও আমি রাঁধবো। তুমি শুধু তরকারীটা রান্না করবে। তোমার হাতের রান্না ছাড়া আমার আর কোথাও খেতে ভাললাগে না। আরও কত মায়ামাখা কথা!” সেই আয়ান আমাকে স্বপ্নের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে একা একা চলে গেল। দিয়ে গেল তার মেয়ের দায়িত্ব।

সূহার কথা শুনে আমার ভাবনার দেয়ালে ছেদ পড়লো। আমি ঝুঁকে ওর নরম হাত দু’টো ধরলাম। পিচ্চি মেয়েটা আমার দিকে এখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ওর তাকানোতে মিশে আছে কৌতূহল। যথার্থ উত্তর পাবার উমেদ। আমি একটু মুচকি হেসে বললাম, “তুমি মাম্মামকে ভালবাসো না, মা?”
-ওমা! বাসবো না কেন? তোমাকেই তো সবচাইতে বেশি ভালোবাসি, মাম্মাম।
-তাহলে বাপীর জন্য ড্রয়ার ভর্তি করে চিঠি লিখো। আর আমার জন্য? আমার জন্য তো একটিও চিঠি লেখলে না, পাখি।

ও এখন মুখ টিপে হাসছে। কি সুন্দর যে লাগছে আমার অপ্সরীটাকে! বয়স মাত্র পাঁচ বছর। তাতেই কত পাকা পাকা কথা শিখেছে। ওর মুখের আদলটা ওর বাবার মতো। গোলগাল ফর্সা একটি মুখ। চোখজোড়াও ওর বাবার মতো মায়াবী। ওর দিকে তাকালে আমার সব কষ্ট নিমিষেই উবে যায়। আয়ানকে যেন আমি ওর মাঝেই খুঁজে পাই।

-মাম্মাম, তুমি কী যে বোকা একটা মেয়ে। হি হি হি! তুমি তো সবসময়ই আমার সাথে থাকো। আমার সাথে খেলো, গল্প করো, খাইয়ে দাও, ঘুম পাড়িয়ে দাও, বেড়াতে নিয়ে যাও। আরও কত কি করো! বাপী কী এগুলো করে? রাইসার বাবা প্রতিদিন কোলে করে স্কুলে রেখে যায়। টিফিন খাইয়ে দেয়। ওরা বাবা-মেয়ে কত দুষ্টুমি যে করে! আমি চুপটি করে আমাদের স্কুলের ঐ বড় বটগাছটা আছে না? তার নীচে চুপটি করে বসে ওদের খেলা দেখি। আমার কি যে ভালোলাগে।

জানো মাম্মাম, একদিন ওরা টিফিন খাবার সময় আংকেল আমাকে দেখেছিল। আমি চোখ নামিয়ে টপাটপ আমার টিফিন গিলতে লাগলাম। আর তাতেই আমার গলায় আটকে গিয়েছিল। আংকেল দৌড়ে এসে আমাকে পানি খাইয়ে আদর করে দিল। রাইসা আর আমার সাথে খেললো। খুব ভাললেগেছিল সেইদিন। আমি মনে মনে বাপীকে মিস করেছিলাম, মাম্মাম।__বলেই ঠোঁট উল্টে কান্না শুরু করে দিল। কি মুশকিল!
আমি ওর চোখ মুছে দিলাম। ওকে আদর করে কোলে তুলে নিয়ে রুমে চলে আসলাম। আমার ব্যাগে সবসময় ওর পছন্দের চকলেট থাকে। চকলেট পেলে ও খুব খুশি হয়।

আমি ব্যাগের চেইন খুলে ওর পছন্দের চকলেট ওর হাতে দিলাম। অন্যদিন হলে খুশিতে লাফাতো। আজ ও চকলেটটা নিল বেশ অখুশী মনে। এরপর আচমকা আমার গলা জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো, “মাম্মাম, আমি শুধু একটাবার বাপী কোলে উঠবো। শুধু একটাবার মাম্মাম, শুধু একটাবার। আমার আর কিছু চাই না।”
সূহার চোখের পানিতে আমার পিঠ ভিজে যাচ্ছে।

আমার যতই কষ্ট হোক আমি আমার বাচ্চাটার সামনে কখনই কাঁদি না। ও আমাকে সবসময়ই হাসতে দেখেছে, কাঁদতে দেখেনি কখনও। কিন্তু আজ আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। আয়ানের স্মৃতিরা আমার চোখের সামনে প্রজাপতি হয়ে উড়তে লাগলো। আমাদের সব স্মৃতিরা আমার মানসে দৃশ্যমান হতে লাগলো। আমি সূহাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। অশ্রুরাও যেন অনেকদিন পর আনন্দে ঝরণার মতো প্রবাহিত হতে লাগলো। সূহাকে আমি কী করে বোঝাবো যে, ওর বাপী বেঁচে নেই। ওর জন্মের তিনদিন আগে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। আমার কষ্টের শেষ মুহূর্তে ওর বাপী আমার পাশে ছিল না। শান্তির ঘুম ছিল আমার প্রিয়মের চোখে। হাসিমুখেই চলে গেছে সে নিজের গন্তব্যে।

আমার আকস্মিক কান্নাতে সূহা ভড়কে গিয়েছে। ও কান্না থামিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিল।
বললো, “মাম্মাম, তুমি কেঁদো না! বাপীর কোলে উঠতে চেয়েছি জন্য তোমার খারাপ লেগেছে তো? ঠিক আছে, আমি আর কখনও বাপীর কোলে উঠতে চাইবো না। বাপী তো আমাকে কখনও দেখতে আসলো না। বাপী পঁচা, তুমি খুব ভালো, মাম্মাম। আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।”

আমি খুব দ্রুত চোখ মুছে ওকে বললাম, “সোনা মা, চলো আজ আমরা সারাদিন রিক্সায় ঘুরবো। তোমার পছন্দের সব খাবার খাবো।”

আমার মেয়েটার অশ্রুসিক্ত চোখ এখন খুশিতে চকচক করছে। দৌড়ে গেল তার পছন্দের জামা আনতে। আমিও চোখ মুখ মুছে রেডি হয়ে ওকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। আজ আর ও একবারও ওর বাপীর কথা বলবে না। মেয়েটা খুব বোঝে। ওকে নিয়ে সারাদিন আজ বাইরেই কাটাবো, বাইরেই খাবো। ও আমার মতো ভ্রমণ পিয়াসু!

Writer: Mahazabin Sharmin Priya

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *