অর্জন

“তুমি কী বুঝতে পারছো, দিন দিন তুমি কতটা অসামাজিক হয়ে যাচ্ছো?”

সন্ধ্যায় বাবা টিভিতে খবর দেখছিলেন। আমি তাকে চা দিয়ে ফিরে আসতেই এই কথা বললেন তিনি। আমি থমকে দাঁড়ালাম। পিছনে ফিরে দেখলাম, তাঁর চোখ এখনো টিভির পর্দার উপরই নিবদ্ধ। থেমে থেমে একটু করে চা’য়ে চুমুক দিচ্ছেন।

আমাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলা অথচ টিভির দিকে এখনো তার গভীর মনোযোগ। বুঝলাম, তিনি আসলেই মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছেন না, মনোযোগের মিথ্যে ভাব ধরে রেখেছেন মাত্র।

আমি আর সামনের দিকে পা বাড়ালাম না। হাসিমুখে বাবার সামনে চলে এলাম। তিনি এখনও টিভি থেকে তাঁর দৃষ্টি সরাননি। আমি মেঝেতেই বসে পড়লাম তার মুখোমুখি হয়ে।

বাবার এই কথায়, তিনি কী বলতে চান তা আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি। তবুও না বোঝার ভান করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মানে?”

এবার তিনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে রিমোট হাতে নিয়ে টিভি বন্ধ করে দিলেন। চা’য়ের কাপ টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলেন। এরপর অকারণেই তাঁর কালো ফ্রেমের মোটা চশমা চোখ থেকে খুলে একটু নাড়াচাড়া করে আবারও চোখে দিলেন।

“মানে আজকের তুমি এবং গত বছরের পূর্ববর্তী তুমি’র মাঝে পার্থক্য করলেই সব বুঝতে পারবে।
সেই সময়কার তুমি ছিলে আমার গর্ব। আর এখনকার তুমি আমার জন্য লজ্জা। তোমার জন্য এখন আমার মান সম্মান সব ধূলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে। ” প্রচণ্ড ক্ষোভ লুকিয়ে শান্ত কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বললেন।

” তোমার কতটা অধঃপতন হয়েছে তা তো তোমার বুঝে আসছে না। ঐদিকে তাকাও। দেখ, এই এক বছরে তোমার অর্জন কতটুকু।” শাহাদত আঙ্গুল দিয়ে টিভির পাশেই রাখা শোকেসের দিকে তিনি ইশারা করলেন।

এই শোকেসটা বাবাই খুব শখ করে বানিয়ে নিয়েছিলেন। এটার দিকে তাকালেই তাঁর রুচিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। মনকাড়া নকশায় সাথে রয়েছে আভিজাত্যের ছোঁয়া।

শোকেসের একদম উপরে মাঝামাঝি জায়গায় বড় করে লেখা “অর্জন”। তার নিচে একটু ছোট কিন্তু স্পষ্ট করে লেখা “মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া”। এর নিচ থেকে নকশা করা অনেকগুলো মাঝারি সাইজের তাক। প্রত্যেকটা তাকের নীচে ছোটমতো কালো প্লেটে করে খোদাই করা আছে পুরষ্কার প্রাপ্ত সময়কার বছর।

২০০৫ থেকে ২০১৯ এই ১৪ বছরে আমার প্রাপ্ত পুরষ্কার, মেডেল ও সনদের সংখ্যা সবমিলিয়ে ১৫০ এর ঊর্ধ্বে। কিন্তু ২০২০ এর অর্জনের তাকটা শূন্য রয়ে গেছে। এই সালে আমি কোনো প্রতিযোগিতায় অংশই নেইনি। তাই ঐ বছর আমার পুরষ্কারের ঝুলিটা শূন্যই রয়ে গেছে।

“গত বছরে, হিদায়েতের মধ্য দিয়ে আমি যেসব অমূল্য জিনিস পেয়েছি তার কাছে শোকেসের এইসবগুলো জিনিসই তুচ্ছ, একদম ফেলনা যাকে বলে। বাবা, আমি আমার রবকে পেয়ে গেছি। এর থেকে আর বড় পাওয়া কী হতে পারে, তুমি আমাকে বলো? তুমিও এসো বাবা এই পথে। দুনিয়ার মোহে আর আটকে থেকো না।” অনেকটা আশা নিয়ে মিনতির সুরে বললাম।

বাবা আমার দিকে রাগত দৃষ্টিতে তাকালেও মুখে কিছু বললেন না। হাতে ধরে রাখা চা’য়ের কাপটি মেঝেতে সজোরে আছাড় মেরে রাগের প্রকাশ ঘটালেন। কাপটি ছোট বড় কয়েক টুকরো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বাবা দরজা খুলে সশব্দে দরজাটা লাগিয়ে বাইরে চলে গেলেন।

বাচ্চাকাল থেকেই পড়াশুনার পাশাপাশি আমাকে নাচ, গান ও অঙ্কন শেখানো হয়। নাচ এবং গানের উস্তাদজি বাসায় এসে নাচ, গান শেখাতেন। আর অঙ্কনের জন্য একটি স্কুলে সপ্তাহে চারদিন ক্লাস করাতে নিয়ে যেতেন বাবা। আবার একটি ক্লাবে ক্যারাটে শিখতাম। এছাড়া আমি খেলাধুলায়ও দুর্দান্ত ছিলাম।

তখন থেকেই আমি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম আর পুরষ্কারে ঝুলি ভরাতাম। আর একটু বড় হয়ে আমি নিজের চেষ্টায় বির্তকের কলাকৌশল শিখতে লাগলাম। এখানেও আমি ভাল করতে থাকি।

আঞ্চলিক পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম। এলাকায় সবাই আমাকে এক নামে চিনতো। আত্মীয় ও বন্ধু মহলে সবসময়ই মধ্যমণি হয়ে থাকতাম আমি। সবখানেই আমার খ্যাতি, সাথে বাবারও। বাবা আমাকে নিয়ে তখন সকলের সামনেই খুব গর্ব করতেন।

এভাবে চলতে চলতে কলেজ পেরিয়ে আমি ভার্সিটি উঠলাম। ভার্সিটির পাশেই একটি মেসে ‘সিনথিয়া’ নামের এক বড় আপুর সাথে থাকতাম। উনি একদম পরিপূর্ণভাবেই ইসলাম মেইনটেইন করতেন। নিয়ম করে নামাজ, সপ্তাহে দু’টো রোজা, রাতের আঁধারে তাহাজ্জুদ এবং মাহরাম মেনে পর্দা করতেন। তাঁর ডিপার্টমেন্টে প্রথম সারির স্টুডেন্টদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। এজন্যই সাধারণত তাঁকে উপেক্ষা করতে পারতাম না।

কিন্তু তাঁর এত ইবাদতের দরুন আমার নাচ, গান খুব একটা প্রাকটিস করা হতো না। আমি হয়তো সন্ধ্যায় মিউজিক ছেড়ে একটু নাচ প্রাকটিস করবো, এশার নামাজ পড়তে আপু অযু করে এসে কানে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কেমন যেন লাগতো। মিউজিক বন্ধ করে আপুকে জায়গা করে দিতাম নামাজের জন্য। আর এইদিকে নিজে রাগে ফুঁসতে থাকতাম।

আবার সকালে উঠে একটু গানের রেওয়াজ করবো, দেখা যায় আপু কুরআন পড়ছেন। এগুলো আর সহ্য করতে না পেরে আমি নিজের মতো থাকার জন্য ছোট্ট একটি বাসা খুঁজতে থাকি। আর মেস মালিককে গিয়ে জানাই পরের মাসে মেস ছাড়ার কথা।

তবে আপুর ব্যক্তিত্ব আমাকে খুব টানতো। বিশেষ করে প্রচণ্ড গরমে আমি যখন সবচে’ পাতলা জামাটা পড়ে বের হই, আপু তখন হাতমোজা,পামোজাসহ আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢেকে বের হোন।

একদিন খুব গরমে কোনো একটা কাজে আপুর সাথে বের হই। কিছু কেনাকাটাও করি। খুব ক্লান্ত অনুভব করায় আপুকে কোথাও একটু বসার কথা বললাম। কিন্তু আপু জানালো একটি বাসায় আজ তালিম হবে, সেটি এখান থেকে ২মিনিটের পথ। ঐটা আপুর এক বান্ধুবির বাসা। আপুকে এখনই সেখানে যেতে হবে। আমাকে তিনি তাঁর সাথে যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। সাথে এ ও বলে দিলেন, ইচ্ছে না হলে রিক্সায় করে মেসে যেন চলে যাই।

আমার কেনো যেন সেখানে যেতে ইচ্ছে করলো। আপুর সাথে যাওয়ার সেই সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই করুণাময় আল্লাহ আমাকে সঠিক পথের সন্ধান দেন। আমি ফিরে পাই সত্য ও ন্যায়ের পথ। ছেড়ে দেই আমার এতদিনের সাধনা। আপুও আমাকে খুব সহায়তা করেছেন। আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুক। আমার প্রতিটি মুনাজাতেই সিনথিয়া আপু থাকেন।

ইসলামে পথ আমার জন্য একদমই মসৃণ ছিল না। অনেক বেশি দুর্গম ছিল। কণ্টকাকীর্ণ সেই পথ আমি একাই পাড়ি দিয়েছি আল্লাহর উপর ভরসা করে। যারা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল, তারা এমন ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতো যেন আমি ডাস্টবিনের কোনো কীট। পরিবারের লোকেরা আমার সাথে কথা বলেনি কয়েক মাস। বাবা তার চেয়েও বেশি সময় কথা বন্ধ রেখেছিলেন।

তবুও আমি ধৈর্যহারা হইনি। প্রতিনিয়ত আমার একমাত্র অভিভাবক ও সাহায্যকারী আল্লাহর কাছে দু’আ করে গিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ, এখন তিনি সবকিছু অনেকটাই সহজ করে দিয়েছেন।

আমাকে জন্ম থেকে এই অবধি এবং যখন আমি গাফেল ছিলাম তখনও তিনি আমাকে যত নিয়ামাহ্ দান করেছেন একজীবনে আমি তার হিসেব দিতে পারব না। শুধু মনে মনে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকি।

কারণ মহামহিম রব বলেছেন,
“যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তবে অবশ্যই তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত আরও বাড়িয়ে দিব।” (সূরা ইবরাহীম: ৭)

“অর্জন”||

লেখা: মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া।

Leave a Comment