অন্যদিন বাসায় ফিরে মেয়েকে আদর করতেন, সেদিন ‘চোখেমুখে ছিল ভয়’

বাসায় ফিরে বলল, ‘ছাত্ররা ধরে নিয়ে গেছে। দায়িত্বই ছেড়ে দেব’। আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। হত্যায় জড়িতদের ফাঁসি চাই। আমার ছয় বছরের মেয়েকে এতিম ও আমাকে স্বামী হারা করল। আমি আমার মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই।

একটানা কথাগুলো বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেন (৩৮) শিক্ষকের স্ত্রী সাবিনা খাতুন রিক্তা।

একটু দম নিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে রিক্তা বলেন, ‘সেদিন মুখে হাসি নিয়েই কুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়েছিল। আর বাসায় ফিরেছিলেন ‘বিধ্বস্ত’ হয়ে। চোখ লাল, অনেকটা বিমর্ষ। আজ ৪টা দিন মেয়ে (জান্নাতুল ফেরদৌস আনিকা (সাড়ে ৬ বছর) খাওয়াতে পারছি না। মেয়েটি কিছুই খাচ্ছেন। শুধু আবদার করছে বাবা না এলে সে খাবে না। এখন আমি কি করব। তিনি চলে গেল এখন আমি কি নিয়ে থাকব।’

সাবিনা খাতুন রিক্তা জানান, ৩০ নভেম্বর সকালে তার স্বামী হাসি মনে কুয়েটে যান। আর দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে বাসায় আসেন। তখন তাকে খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। অন্যদিন বাসায় এসেই মেয়েকে কোলে তুলে নিতেন। বাবা না এলে মেয়ে কখনো খেত না। কিন্তু ওইদিন বাসায় এসেই তিনি আমাকে ‘ছাত্ররা তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা’ জানান। দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন বলেও জানিয়েই নিজের কক্ষে চলে যান। তখন তার চোখেমুখে ভয় ছিল। এরপর তিনি গোসল করতে বাথরুমে ঢোকেন।

রিক্তা মেয়েকে বলেন, বাবার ল্যাব আছে তিনি আবার অফিসে যাবেন তুমি ঘুমিয়ে পড়। কিন্তু একটু পরেই মেয়ে গিয়ে বাথরুমের দরজা ঠেলতে থাকে। দরজা না খোলায় মেয়ে এসে সে কথা জানায়।

রিক্তা বলেন, ‘কিছু বুঝতে না পেরে চিল্লাপাল্লা করি। তখন আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। এরপর বাথরুমের দরজা ভেঙে তাকে বসা অবস্থায় দেখি। কিন্তু চোখ বন্ধ। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। মুখে পানি ছিটা দিলে চোখ খোলে। কিন্তু কথা বলতে পারেনি। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়।’

তিনি জানান, ‘ছয় বছরের প্রেম ছিল তাদের। তারপর পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। এরপর কেটে গেছে আরও ১০ বছর। সংসারের কোনো কাজই তাকে বলা লাগত না। বাসায় রাতের মশারিও নিজে টানাতো। বাসায় থাকাকালে আমাকে কোনো কাজ করতে দিতো না। চাকরিতে চলে গেলেও বাসার খোঁজখবর রাখত সব সময়। সেই মানুষটার এমন মৃত্যু আমি সইতে পারছি না। আট বছর আগে পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে তাকে সঙ্গে নিয়েই যান। সেখানে চার বছর থাকার পর দেশে ফিরে এসে কুয়েটে যোগ দেন। করোনার মধ্যে প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি পান। একই সঙ্গে হলের প্রভোস্ট হন। কখনো তাকে একা ছাড়তেন না। কোথায় গেলে তাকে হাত ধরে রাস্তা পার করাতেন। বাসায় ফিরে মেয়েকে কোলে বসিয়ে গল্প করতেন। তিনি  মেয়েকে বলতেন ‘তোর বাবা কোনো দিন বুড়ো হবে না’।

স্বামী হারানো সাবিনা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘কুয়েট কর্তৃপক্ষ এ ঘটনা নিয়ে মামলা না করলে আমি নিজেই বাদী হয়ে মামলা করব। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাইব। আমার মেয়েকে এতিম করা হয়েছে। জড়িতদের ফাঁসি চাই। ক্ষতিপূরণ চাই।’

কুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রতীক চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, সেলিমের মৃত্যুর পর সাধারণ সভা করে আমরা এ ঘটনায় দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিতে জন্য কুয়েট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছি। পাশাপাশি শিক্ষক সেলিমের নিয়মিত পাওনার বাইরে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অতিরিক্ত এক কোটি টাকা পরিবারকে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।’

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) দুপুর ৩ টার দিকে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান কুয়েট শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেন। তিনি কুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ও লালন শাহ হলের প্রভোস্ট ছিলেন।

জানা গেছে, সম্প্রতি কুয়েটের লালন শাহ হলে ছাত্র আবাসিক হলের ডিসেম্বর মাসের খাদ্য-ব্যবস্থাপক (ডাইনিং ম্যানেজার) নির্বাচন নিয়ে, সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান প্যানেলের বিরুদ্ধে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার প্রচেষ্টার অভিযোগ ওঠে।

ওই প্যানেলের সদস্যরা- প্রভোস্ট ড. সেলিম হোসেনকে নিয়মিত হুমকি দিয়ে আসছিলেন, তাদের মনোনীত প্রার্থীকে নির্বাচন করার জন্য। তারই ধারাবাহিকতায় ৩০ নভেম্বর দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের একটি ক্যাডার গ্রুপ ক্যাম্পাসের রাস্তা হতে ড. সেলিম হোসেনকে জেরা করা শুরু করে। পরবর্তীতে তারা শিক্ষককে অনুসরণ করে তার ব্যক্তিগত কক্ষ (তড়িৎ প্রকৌশল ভবন) এ প্রবেশ করেন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তারা আনুমানিক আধঘণ্টা ওই শিক্ষকের সঙ্গে রুদ্ধদার বৈঠক করে। এতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ও অসুস্থ হয়ে যান।

পরবর্তীতে, শিক্ষক ড. সেলিম হোসেন দুপুরে খাবারের উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাস নিকটস্থ বাসায় যাওয়ার পর ২টা ৩০ মিনিটে তার স্ত্রী লক্ষ্য করেন তিনি বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। পরে, দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে, কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

Leave a Comment