দেশে করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ২৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সীরা। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে ষাটোর্ধ্বদের। সংখ্যার দিক থেকে মোট এবং দৈনিক হিসাবে ষাটোর্ধ্বরা দেশে সংক্রমণের শুরু থেকেই সর্বোচ্চ মৃত্যুর জায়গায় রয়েছে। তবে গত দুই মাসের দৈনিক হিসাব বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে ভিন্ন এক চিত্র। গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের ১৩ মে পর্যন্ত ১৪ মাসে দৈনিক যে হারে বিভিন্ন বয়সীদের মৃত্যু ঘটেছে, সেই তুলনায় গত দুই মাসে দৈনিক আনুপাতিক মৃত্যুহার বেশি হচ্ছে ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের। আর সংক্রমণ যতই বাড়ছে তা ছড়িয়ে পড়ছে সব বয়সীদের মধ্যে। এমনকি নবজাতক থেকে শুরু করে চার বছর বয়সী শিশুরাও উদ্বেগজনক হারে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে।
জানতে চাইলে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব বয়সের মানুষের মধ্যেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে এবং ঘটবে। শিশুদের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়ায় না—এটা এখন পর্যন্ত কেউ বলেনি। বরং আমরা বরাবরই বলছি, যে পরিবারে শিশু ও বয়স্করা রয়েছে তাদের আক্রান্ত করার জন্য দায়ী অন্য বয়সীরা, যারা বাইরে গিয়ে সংক্রমণ ঘরে টেনে আনছে। এ ছাড়া সব সময়ই অপেক্ষাকৃত তরুণরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, কারণ তারাই বেশি বাইরে যায়। ফলে তাদের মধ্যে যারা জানা-অজানা জটিল রোগে আগে থেকে আক্রান্ত, তারা তো মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকবেই। সেটা শিশুদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। যেমনটা বয়স্কদের সবচেয়ে বেশি হয়।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এককথায় বলতে গেলে আক্রান্ত বাড়লে মৃত্যু বাড়বেই। সেটা আনুপাতিক হারে সব বয়সের ওপরই প্রভাব পড়ে। আগে যেহেতু আক্রান্ত তুলনামূলক কম ছিল ফলে তরুণদের মৃত্যুও কম দেখা গেছে। কিন্তু এখন সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাদের অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে, নিজের জন্য এবং পরিবারের অন্যদের জন্য।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন সময়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত দুই মাসে দৈনিক মৃত্যুর গড় হার বেড়েছে ৩১-৪০ বছর বয়সীদের ৭৭.৫২ শতাংশ, তার পরই ২১-৩০ বছরের বেড়েছে ৭৭.৪৩ শতাংশ, ৪১-৫০ বছর বয়সীদের বেড়েছে ৭১.৬০ শতাংশ, ৫১-৬০ বছর বয়সীদের মৃত্যু বেড়েছে ৬৫.২৮ শতাংশ, ষাটোর্ধ্বদের মৃত্যু বেড়েছে ৬৩ শতাংশ।
আবার ১০ বছরের নিচের বয়সীদের দৈনিক মৃত্যু বেড়েছে ৯ শতাংশ এবং ১১-২০ বছর বয়সীদের বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। গত ১৪ মাসের মৃত্যুর দৈনিক বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যান এবং গত দুই মাসের দৈনিক বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যানের আনুপাতিক ব্যবধান বিশ্লেষণ থেকে এই চিত্র মেলে। দেখা যায়, প্রথম ১৪ মাসে দেশে দিনে গড়ে সর্বোচ্চ ১৬ জন করে মারা যায় ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরা। আর গত দুই মাসে ওই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪-এ।
প্রথম ১৪ মাসে ৫১-৬০ বছর বয়সীদের দৈনিক মৃত্যু হয় গড়ে সাতজন করে আর গত দুই মাসে দৈনিক এই বয়সীদের গড়ে মৃত্যু হয় ২০ জন করে। ৪১-৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রথম ১৪ মাসে দৈনিক মৃত্যু হয় গড়ে ৩.১৮ জনের আর গত দুই মাসে এই বয়সীরা দিনে মারা যায় গড়ে ১১ জন করে। ৩১-৪০ বছর বয়সীদের প্রথম ১৪ মাসে দৈনিক মৃত্যু হয় গড়ে ১.৪০ জন করে আর গত দুই মাসে তাদের মৃত্যু হয় গড়ে ৬.২৩ জন করে।
২১-৩০ বছর বয়সীদের ১৪ মাসে মৃত্যু হয় দৈনিক গড়ে ০.৫১ জন এবং গত দুই মাসে মৃত্যু হয় গড়ে ২.২৬ জন করে। প্রথম ১৪ মাসে ১১-২০ বছর বয়সীদের মৃত্যু হয় দৈনিক গড়ে ০.১৯ জন করে এবং গত দুই মাসে মৃত্যু হয় গড়ে ০.৪৩ শতাংশ।
১০ বছরের নিচের বয়সীদের প্রথম ১৪ মাসে দৈনিক মৃত্যু হয় গড়ে ০.১০ জন করে, গত দুই মাসে তাদের দৈনিক মৃত্যু দাঁড়ায় গড়ে ০.১১ জনে।
সংখ্যার তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, প্রথম ১৪ মাসে (১৩ মে পর্যন্ত) ১০ বছরের নিচের শিশুদের মৃত্যু হয়েছিল ৪৬ জনের, আর গত দুই মাসে এই বয়সী মারা গেছে ৯ জন। ১৪ মাসে ১১-২০ বছরের মারা যায় ৮০ জন, গত দুই মাসে মারা যায় ২৬ জন। ১৪ মাসে ২১-৩০ বছরের মারা যায় ২১৫ জন, গত দুই মাসে মারা গেছে ১৩৬ জন। ১৪ মাসে ৩১-৪০ বছরের মারা যায় ৫৯১ জন এবং গত দুই মাসে মারা যায় ৩৭৪ জন। ১৪ মাসে ৪১-৫০ বছরের মারা যায় এক হাজার ৩৩৭ জন, গত দুই মাসে মারা যায় ৬৭২ জন। ১৪ মাসে ৫১-৬০ বছরের মারা যায় দুই হাজার ৯১২ জন, গত দুই মাসে মারা যায় এক হাজার ১৯৮ জন। ১৪ মাসে ষাটোর্ধ্ব মারা যায় ছয় হাজার ৮১৫ জন এবং দুই মাসে মারা গেছে দুই হাজার ৬৪৩ জন।
এ পর্যন্ত মোট মৃতদের মধ্যে ষাটোর্ধ্বরা মারা গেছে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৪৫৮ জন (৫৫.৪৭ শতাংশ), ৫১-৬০ বছরের চার হাজার ১১০ জন (২৪.১০ শতাংশ) ৪১-৫০ বছরের দুই হাজার ৯ জন (১১.৭৮ শতাংশ), ৩১-৪০ বছরের ৯৬৫ জন (৫.৬৬ শতাংশ), ২১-৩০ বছরের ৩৫১ জন (২.০৬ শতাংশ), ১১-২০ বছরের ১০৬ জন (০.৬২ শতাংশ) এবং ১০ বছরের নিচের মারা গেছে ৫৩ জন (০.৩১ শতাংশ)।
এদিকে আক্রান্তদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় গত ১ জানুয়ারিও দেশে ০-৪ বছর বয়সের শিশু আক্রান্ত হয়েছিল মাত্র ২৩ জন। গত এপ্রিলে যখন সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় ওঠে তখন সবচেয়ে বেশি শিশু আক্রান্ত হয়েছিল ৯ এপ্রিল, ৮৩ জন। কিন্তু চলতি মাসে আড়াই গুণ বেড়ে গত ১২ জুলাই আক্রান্ত হয়েছিল ২১২টি শিশু।
শিশুদের আক্রান্ত বাড়া প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাকিল আহম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, কোলের শিশুরা তো আর নিজেরা বাইরে যেতে পারে না। হয়তো বড়রা তাদের অসতর্কভাবে বাইরে নিয়ে আক্রান্ত করেন অথবা নিজেরা আক্রান্ত হয়ে বাসায় ফিরে শিশুদের কাছে যাওয়ায় তারা আক্রান্ত হয়। যদিও শিশুদের করোনায় মৃত্যুহার একদমই কম। খুব জটিল কোনো সমস্যা না হলে শুধু করোনায় শিশুদের কারোর মৃত্যুর রেকর্ড নেই।
এদিকে সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে নারীদের আক্রান্ত হওয়া আরো বেড়ে গেছে। যেমন গত ৬ এপ্রিল পুরুষ শনাক্ত ছিল চার হাজার ৫০৫ জন, নারী শনাক্ত ছিল দুই হাজার ৬৬৭ জন। তুলনায় গত ১২ জুলাই পুরুষ শনাক্ত হয় পাঁচ হাজার ৯৭৪ জন আর নারী চার হাজার ৫৭৪ জন।