হাফসা বিনতে উমর রা.-এর জীবনী

উমর (রা.) তার মেয়ের ব্যপারে চিন্তিত ছিলেন। তার মেয়ে খুব অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে যান। তাই তিনি তার মেয়ের জন্য ভালো একজন স্বামী খোঁজার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাই তিনি তার সবসময়ের সাথী আবু বকর (রা.) এর কাছে গেলেন। আবু বকর (রা.) কোন সিদ্ধান্তই জানালেন না। তাই তিনি এবার গেলেন উসমান (রা.) এর সাথে কথা বলার জন্য। উসমান (রা.) বললেন, ‘আমি আপনাকে শীঘ্রই জানাব এ ব্যাপারে।’ সময় গড়িয়ে গেল কিন্তু উসমান (রা.) পরবর্তীতে কিছু জানালেন না। তাই তিনি তাকে খুঁজতে গিয়ে মসজিদে খুঁজে পেলেন। যখন উসমান (রা.) টের পেলেন যে উমর (রা.) তার কাছে এসে বসেছেন তখন তিনি তার সালাত দীর্ঘায়িত করতে লাগলেন, তিনি তার সালাত শেষ করতে চাইছিলেন না। কারণ সময়টা তার জন্য বিব্রতকর ছিল।

উসমান (রা.) এর নামাজ শেষ হবার পর উমর (রা.) তার দিকে গেলেন। তিনি বললেনঃ ‘আমি এখনও তোমার উত্তরের জন্য অপেক্ষায় রয়েছি।’ উসমান (রা.) বললেন, ‘আমি আসলে বর্তমানে বিয়ের ব্যাপারে কোন আগ্রহ বোধ করছি না।’ উমর (রা.) এতে কিছুটা হতাশ হলেন। আবু বকরও (রা.) কিছু বললেন না, উসমান (রা.) ও বিয়ে করতে চাইছেন না তাই এই পর্যায়ে তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে কথা বলতে গেলেন আবু বকর (রা.) ও উসমান (রা.) এর সাথে ঘটা ঘটনাটি জানানোর জন্য। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আবু বকর (রা.) ও উসমানের (রা.) কাছে গিয়ে আমার মেয়ে হাফসাকে (রা.) বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু আবু বকর (রা.) কোন সিদ্ধান্ত জানাননি। উসমানও বললেন যে তার বিয়েতে কোন আগ্রহ নেই।’ তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উমর (রা.) কে বললেন, ‘হে উমর! আবু বকর (রা.) এবং উসমান (রা.) এর চেয়ে উত্তম কেউ হাফসাকে (রা.) বিয়ে করবে।’ এটা শুনে উমর (রা.) অভিভূত হলেন। তিনি সাথেসাথেই বুঝে গিয়েছিলেন তারপরেও একটা স্পষ্ট উত্তর তিনি চাইছিলেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছ থেকে। তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘আমি হাফসাকে (রা.) বিয়ে করব এবং উসমান (রা.) আমার মেয়ে উম্মে কুলসুমকে (রা.) কে বিয়ে করবে।’

উসমান (রা.) এর সেসময় বিয়ে করতে না চাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হল কিছুদিন আগেই তার স্ত্রী রুকাইয়া (রা.) [রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মেয়ে] ইন্তেকাল করেছেন। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাইছিলেন উসমান (রা.) যেন তার অন্য মেয়ে উম্মে কুলসুম (রা.)কে বিয়ে করে।

উমর (রা.) এর মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। আবু বকর (রা.) তাকে মসজিদের বাইরে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি জানতেন যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসাকে (রা.) বিয়ে করতে চান। তিনি উমর (রা.) কে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ ‘হে উমর! আমি যখন তোমার মেয়েকে বিয়ের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত জানাইনি তখন তুমি হয়ত হতাশ হয়েছিলে।’ তখন উমর হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন। তখন আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে কোন জবাব দেইনি কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পূর্বেই আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি হাফসা (রা.)কে বিয়ে করতে চান। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিষয়টি গোপন করতে চেয়েছিলেন আর আমিও তার গোপনীয়তাকে রক্ষা করেছি। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমার কাছে গিয়েই হাফসা (রা.) এর ব্যাপারে কথা বলতেন এবং জানাতেন যে তিনি তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে আগ্রহী।’

উসমান (রা.) এর সাথেও উমর (রা.) এর দেখা হয়। উসমান (রা.) বলেন, ‘আপনার মেয়েকে বিয়ে না করার অন্যতম কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কাছে ইতিমধ্যেই এসে তার অন্য মেয়েকে বিয়েকে বিয়ে দেবার প্রস্তাব দিয়েছেন।’ হয়ত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উসমান (রা.) কে বলেছিলেন তিনি হাফসা (রা.) কে বিয়ে করতে চান।

হাফসা বিনতে উমর আল খাত্তাব (রা.), ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির কন্যা। তার মায়ের নাম জয়নব বিনতে আল মা’জুন (রা.) যিনি বিখ্যাত সাহাবি উসমান ইবনে আল মা’জুন এর বোন।

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নবুওয়াতের ৫ বছর আগে হাফসা (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে বিয়ের আগেও তার বিয়ে হয়েছিল। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাকে বিয়ে করেন তখন তিনি বিধবা। তার প্রথম স্বামী ছিলেন খুনাইস ইবনে হুজাফা আল-সাহমি (রা.)। তারা একসাথে আল-হাবাশা অর্থাৎ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। কিছু কুরাইশ নেতার ইসলাম গ্রহণের গুজব শুনে তারা মক্কায় ফিরে আসেন। এরপরে তারা আবার মদিনায় হিজরত করেন।

খুনাইস (রা.) সেসকল সৌভাগ্যবান সাহাবীদের একজন যারা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে উহুদেও অংশ নেন। তিনি উহুদে সরাসরি মারা যান নি, বরং পরবর্তীতে আঘাতের কারণে মারা যান।

তো, হাফসা (রা.) সেসময় বিধবা হয়ে গেলেন, মাত্র ২১ বছর বয়সে। তিনি প্রচুর নামাজ আদায় ও রোজা রাখার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিলেন। এ নিয়ে একটি ঘটনা ঘটে। যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর স্ত্রীরা তাদের প্রতি ব্যয় বৃদ্ধির অনুরোধ জানিয়েছিলেন তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার স্ত্রীদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন।

যখন হাফসা (রা.) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বিয়ে করেন, উমর (রা.) তখন তার মেয়েকে কিছু উত্তম উপদেশ দান করেন যা প্রতিটা বাবার তার মেয়েকে দেয়া উচিত। হাফসা (রা.) ঈর্ষান্বিত হতেন। উমর (রা.) বলেন, ‘হে আমার মেয়ে! তোমার ভেতরে ঈর্ষা রয়েছে। তাই এখন থেকেই তোমার ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণ কর। তোমার ঈর্ষা যেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে সম্পর্ক অবনতির কারণ না হয়। আইশা (রা.) এর সাথে প্রতিযোগিতা করতে যেয়ো না কারণ তিনি তোমার যেয়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট অধিক প্রিয় এবং তার বাবাও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট তোমার বাবার চেয়ে অধিক প্রিয়। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেন কখনই তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট না হয়। কারণ তিনি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হলে তোমাকে ত্যাগ করবেন এবং আমার প্রতিও হতাশ হবেন। তোমার কারণে পরিবারের বড় সমস্যা হবে। এমন সমস্যা যা আমরা এড়াতে পারব না আবার মুখোমুখিও হতে পারব না।’

এই উপদেশটি প্রতিটা পিতামাতার তার সন্তানদের দেয়া উচিত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে বিয়ের আগে থেকেই আইশা (রা.) ও হাফসা (রা.) ভালো বান্ধবী ছিলেন। একে অপরের সাথেও প্রচুর কথা বলতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার স্ত্রী জয়নব বিনতে জাহশ (রা.) এর কাছে যেতেন। তার সম্পর্কে আইশা (রা.) বলেন, ‘আমি জানতাম তিনিই একমাত্র যিনি আমার সাথে প্রতিযোগিতা করবেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার অপর স্ত্রী যায়নব (রা.) এর বাসায় যেয়ে মধু খেতেন। তাই তারা [হাফসা ও আইশা (রা.) ] রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর খাটানোর জন্য একটি ফন্দি আঁটলেন। তারা একে অপরকে বললেনঃ ‘যদি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমার কাছে আসে তাহলে তাকে বলবে আপনার কাছ থেকে মাঘাফির এর গন্ধ আসছে।’ মাঘাফির এক ধরণের উদ্ভিদ যা সেসময়ের আরবরা খেত আর সেটা গন্ধযুক্ত ছিল। তারা দুইজনেই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে একই জিনিস বলতে যাচ্ছিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথমে আইশা (রা.) আর বাড়িতে গেলে তিনি বললেন, আপনার কাছ থেকে মাঘাফির এর গন্ধ আসছে। এরপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসা (রা.) এর কাছ থেকেও একই কথা শুনলেন। শুনে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘আমি তো মাঘাফির খাইনি, আসাল খেয়েছি।’ তখন হাফসা (রা.) বললেন, ‘তাহলে আপনি হয়ত মধু খেয়েছেন এবং সেই মধু এমন কোন মৌমাছি এমন কোন জায়গা থেকে এসেছে যেখানে মাঘাফির ছিল।’ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বুঝতে পারলেন তারা কিসের কথা বলতে চাইছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘ঠিক আছে। আজকের পর থেকে আমি আর মধু খাবনা।’ এভাবেই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমস্যাটির সমাধান করতে চেয়েছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেননি আমি আর যয়নব (রা.) এর কাছে যাবনা, তিনি শুধু বলেছেন আমি আর সেখানে মধু খাব না। এভাবেই কাহিনীর সমাপ্তি ঘটল সহজেই।

তবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর স্ত্রীদের মধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটে যা নির্দেশ করে দিনশেষে তারাও রক্তমাংসে গড়া মানুষ। হাফসা (রা.) এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অন্যান্য স্ত্রীদের সাথে আরেকজনের প্রতিযোগিতা চলছিল যার নাম মারিয়া (রা.)। তিনি যখন ইব্রাহিম (রা.) এর জন্ম দেন, এরপরেই তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়। মারিয়া (রা.) অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন যা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অন্যান্য স্ত্রীদের ঈর্ষান্বিত করত। একদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাফসা (রা.) এর সাথে দিন কাটানোর কথা ছিল কিন্তু রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেদিনটি মারিয়া (রা.) এর সাথে কাটান। এতে হাফসা (রা.) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। এরপরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসা (রা.) কে বলেনঃ ‘আমি যদি আর কখনো মারিয়া (রা.) এর কাছে না যাই তুমি কি সন্তুষ্ট হবে?’ হাফসা (রা.) হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘ঠিক আছে। আমি তাহলে আর মারিয়া (রা.) এর কাছে যাবনা। কিন্তু তুমি এই ব্যাপারটা আমার এবং তোমার মধ্যেই গোপন রাখ, আর কাউকে বলোনা।’ কিন্তু হাফসা তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী আইশা (রা.) এর কাছে গিয়ে ব্যাপারটি বলে দিলেন। তখন আল্লাহ তার রাসূলকে জানালেন যে হাফসা (রা.) আয়িশাকে (রা.) জানিয়ে দিয়েছেন আর এ ঘটনাটি স্ত্রীদের মধ্যেও ছড়িয়েছে। এভাবেই তারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর একটি গোপনীয়তাকে প্রকাশ করেন।

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জানতে পেরে তার স্ত্রীদের প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন এবং তার কোন স্ত্রীদের কাছে যাওয়া হতে বিরত থাকলেন। গুজব ছড়াল যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সকল স্ত্রীকে তালাক্ব দিয়েছেন। উমর (রা.) বলেন, ‘আমি মদিনার বাইরের এক জায়গাতেই কাজ করতাম। আমার সেখানে কাজের সাথী ছিল যার সাথে এক সাথে একই ভূমিতে কাজ করতাম। আমি একদিন কাজ করতাম, সে আরেকদিন কাজ করত। আমি যেদিন কাজ করতাম সেদিন সে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে থাকত এবং সেদিন সে যা যা শিখত তা আমার কাছে বেলাশেষে এসে জানিয়ে দিত। যেদিন আমি কাজ করতাম না সেদিন আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে যেতাম এবং যা যা শিখতাম তা তাকে জানাতাম। একদিন আমার সঙ্গী আমার কাছে এসে বললঃ ‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সকল স্ত্রীকে তালাক্ব দিয়েছেন।‘ উমর (রা.) তার হাতে থাকা সবকিছু ফেলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে ছুটে গেলেন। তিনি মসজিদে গেলেন কিন্তু সেখানে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে দেখতে পেলেন না। সেখানে অন্যান্য সাহাবিরা মন খারাপ করে বসে ছিলেন কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মন বিমর্ষ ছিল। তো উমর (রা.) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে খুঁজতে খুঁজতে তাকে পেলেন মদিনা বা মদিনার কাছাকাছি কোন পাহাড়ের চূড়ায়। যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাকী ইবাদত করতে চাইতেন তখন তিনি সেখানে যেতেন।

উমর (রা.) সেখানে গিয়ে দেখলেন বাইরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন যিনি যে কাউকে বাধা দিচ্ছেন যেন কেউ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে গিয়ে তাকে বিরক্ত না করতে পারে কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মন খারাপের কারণে কারো সাথেই কথা বলতে চাইছিলেন না। উমর (রা.) রাবাহকে বললেন, ‘তুমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস কর আমি তার সাথে কথা বলতে পারব কিনা?’ তাই রাবাহ (রা.) ভেতরে গেলেন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে গিয়ে বললেন যে উমর (রা.) বাইরে অপেক্ষা করছেন, ভেতরে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করছেন, তিনি আপনার সাথে কথা বলতে চান। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন জবাব দিলেন না। তাই রাবাহ (রা.) উমর (রা.) এর কাছে ফিরে গিয়ে বললেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন জবাব দেন নি। উমর (রা.) আবার চেষ্টা করলেন। তাতেও কাজ না হলে তৃতীয়বার। তৃতীয়বারের পর উমর (রা.) তার স্বর উঁচু করলেন যেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কথা শুনতে পান। তিনি বললেনঃ ‘হে রাবাহ! রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে গিয়ে বল আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। আমি প্রতিজ্ঞা করছি আমি তার সাথে হাফসা এবং তার অন্যান্য স্ত্রী (রা.) এর ব্যাপারে কোন কথা বলব না।’ এবার রাবাহ (রা.) ভেতরে গেলেন এবং অন্যান্যবারের তুলনায় বেশী সময় ভেতরে অবস্থান করলেন। তাই উমর (রা.) ভাবলেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সাথে কথা বলতে চাইছেন না। তাই তিনি ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। যখন তিনি ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন রাবাহ (রা.) পিছন থেকে তাকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথা বলার অনুমতি দিয়েছেন তবে এক শর্তে।’

এরপর উমর (রা.) ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং পরিস্থিতি হালকা করতে চাইলেন। তিনি বললেনঃ ‘হে রাসূলুল্লাহ! আমরা যখন মক্কায় ছিলাম তখন আমাদের নারীরা আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, কখনোই প্রতিউত্তর করত না। আমরা এখন মদিনায় এসেছি আর তারাও মদিনার মহিলাদের কাছ থেকে শিখেছে কিভাবে প্রতিউত্তর দিতে হয়। এরপরে তারাই আমাদের প্রতিউত্তর আর নির্দেশ দিচ্ছে।’ এটা শুনে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাসতে লাগলেন। যখন উমর (রা.) বুঝলেন তিনি পরিস্থিতি হালকা করতে সক্ষম হয়েছেন তখন তিনি বললেনঃ ‘হে রাসূলুল্লাহ! নারীদের ব্যাপারে মন খারাপ করবেন না। আপনি যদি বিয়ে করতে চান তাহলে অন্য নারীদের বিয়ে করুন। কিন্তু হে রাসূলুল্লাহ, আপনি কি আপনার স্ত্রীদের তালাক্ব দিয়েছেন? রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘আমি আমার কোন স্ত্রীকেই তালাক্ব দিইনি।’ এটা শুনে উমর (রা.) তাকবির দিতে শুরু করলেন। বাইরে যেই সাহাবা ছিলেন তিনি উমর (রা.) কে তাকবির দিতে শুনে তার কন্ঠও আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ধ্বনিতে ধ্বনিত হতে লাগল।

এরপর উমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে রাসূলুল্লাহ! আপনি কি হাফসাকে (রা.) ত্বালাক দিয়েছেন?’ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নেতিবাচক জবাব দিলেন। উমর (রা.) বললেন, ‘হে রাসূলুল্লাহ! যদি হাফসা (রা.) কে ঠিক করতে হয় তাহলে আপনার জন্য আমি তাই করব।’ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘হে উমর! আমাদের সমস্যাটা খুবই তুচ্ছ আর আমি কোন স্ত্রীকেই ত্বালাক দেইনি।’

হাফসা (রা.) তার বাবার মত ছিলেন। তার শক্তিমত্তা, বলিষ্ঠতা, বুদ্ধিমতা তার পিতা উমর ইবনে আল-খাত্তাব (রা.) এর মতই ছিল। তার সাথে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হত। তিনি সেসময় সামান্য কয়েকজন নারীর একজন ছিলেন যারা লিখতে জানত। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মারা যান তখনও কুরআনকে একত্রিত করা হয়নি। সেসময় কুরআন সাহাবাদের অন্তরে লিপিবদ্ধ ছিল। তাছাড়া কাঠ, পাথর অথবা চামড়ার উপর লিখে রাখার চল ছিল। উমর (রা.) আবু বকর (রা.) এর কাছে গিয়ে কুরআনকে একটি মুসহাফে লিপিবদ্ধ করার অনুরোধ জানান। এরপরে যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)কে কুরআনকে একটি মুসহাফে একত্রিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই মুসহাফটি জমা থাকে আবু বকর (রা.) এর কাছে। যখন আবু বকর (রা.) মারা যান তখন তা চলে আসে উমর (রা.) এর কাছে। তার ইন্তেকালের পর মুসহাফটি সংরক্ষণ করা হয়েছিল হাফসা (রা.) এর বাড়িতে। পৃথিবীর প্রথম একত্রিতকৃত কুরআনের পান্ডুলিপি হাফসা (রা.) এর বাড়িতেই রাখা হয়।

এখান থেকেই বোঝা যায় ইসলামে নারীদের অবদান এবং আধিপত্যের কথা, কিভাবে তারা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ দায়িত্বও সফলতার সামনে পালন করেছেন, কিভাবে তারা তাদের সম্মানকে অসীম মর্যাদায় সমাসীন করেছেন।

হাফসা (রা.) ফুকাহাদের একজন এবং অত্যন্ত জ্ঞানী ও মেধাবী ছিলেন। তার আপন ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হাফসা (রা.) এর কাছে যেয়ে দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করতেন। হাফসা (রা.) এর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আইশা (রা.) এর সাথে তার উত্তম সম্পর্ক বজিয়ে ছিল।

হাফসা (রা.) হিজরী ৪৫ সনে ইন্তেকাল করেন। অনেক সাহাবিই তার

জন্য দুয়া প্রার্থনা করেন। তাকে সমাহিত করেন তার ভাই এবং ভাইপোরা।

মহান আল্লাহ আমাদের সম্মানিত নারীদের হাফসা (রা.) এর উত্তম আদর্শ গ্রহণের তাওফিক দান করুন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *