স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে কী শেখানো হচ্ছে?

স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে কী শেখানো হচ্ছে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুজতে তৃতীয় ও দশম শ্রেণী পর্যন্ত “বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়” এবং “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” বিষয়কগুলো এক নজর দেখলাম। সংক্ষেপে কয়েকটা পয়েন্ট বলি।
.
১। ইসলামবিদ্বেষ: পাঠ্যপুস্তকে এমন কিছু বক্তব্য আছে যেগুলো স্পষ্টভাবে ইসলামবিদ্বেষী। সপ্তম শ্রেনীর “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” (অনুশীলন) বইয়ের ১২১ পৃষ্ঠায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা থেকে এমন কিছু অংশ উল্লেখ করা হয়েছে যা ইসলামের প্রতি; বিশেষ করে পর্দার বিধানের প্রতি বিদ্বেষ এবং তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে।
.
পর্দা করা মুসলিম নারীদের উপস্থাপন করা হয়েছে নির্বোধ, মূর্খ, ভয়ঙ্কর এবং সাব-হিউম্যান টাইপের কিছু একটা হিসেবে। যেসব কথা এখানে তুলে ধরা হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বেও সেগুলো ইসলামবিদ্বেষ মনে করা হয়। রোকেয়ার চেয়ে আরও কম গুরুতর কথা বলে ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, অস্ট্রেলিয়ার সংসদ সদস্য পলাইন হ্যানসনের মতো রাজনীতিবিদেরা সমালোচিত হয়েছে।
.
এধরণের বিদ্বেষপূর্ণ শিক্ষা সমাজে বৈষম্য, ঘৃণা এবং সহিংসতার ক্ষেত্র ও বৈধতা প্রস্তত করে। যার বিভিন্ন উদাহরণ আমরা আমাদের সমাজে দেখছি। যে দেশের ক্লাস সেভেনের বইতে বোরকাকে ‘বস্তা’ আর পর্দা করা নারীকে ‘ভূত’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, সেদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলাম পালনের জন্য মুসলিম তরুণীদের বৈষম্য, অপমান এবং ঘৃণার শিকার হওয়া স্বাভাবিক। ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ কিভাবে সহিংসতায় পরিণত হয় তা বুয়েটের আবরার ফাহাদসহ বিভিন্ন ঘটনায় আমরা দেখছি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এই বৈষম্য, ঘৃণা, ও সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রস্তুত করছে।
.
২। এলজি টিভি মতবাদ: সপ্তম শ্রেনীর “ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান” বইয়ের ৫১ পৃষ্ঠা থেকে শুরু হওয়া “শরীফার গল্প” নামক আলোচনাতে শিক্ষার্থীদের পশ্চিম থেকে আমদানী করা এলজি টিভির বিকৃত মতবাদে দীক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। পেশ করা হয়েছে বেশ কিছু বিভ্রান্তিরকর বক্তব্য।
.
যেমন – ইন্টারসেক্স এবং ট্র্যান্স– এ দুই অবস্থানকে এক করে তুলে ধরা হয়েছে। ইন্টারসেক্স হল এমন মানুষ যার শারীরিক বা ডিএনএ-গত কোন ত্রুটি আছে। ট্র্যান্স হল এমন কেউ যার শারীরিক কোন ইস্যু নেই, কিন্তু সে “মনে করে” সে ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ।
.
সহনশীলতার নামে ট্র্যান্স-কে তুলে ধরা হয়েছে স্বাভাবিক হিসেবে। মানসিক বা আচরণগত ত্রুটি থাকা কোন মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তাকে সাহায্য করা এক কথা। কিন্তু ত্রুটিগুলোকে স্বাভাবিক আচরণ, গ্রহণযোগ্য আচরণ হিসেবে উপস্থাপন করা একেবারেই আলাদা একটি বিষয়। বইতে দ্বিতীয়টা করা হয়েছে।
.
পশ্চিমা বিশ্বের এলজি টিভি মতবাদ বায়োলজিক সেক্স, জেন্ডার আইডেন্টিটি এবং সেক্সুয়াল ওয়ির‍্যেন্টেশনের মধ্যে বানোয়াট শ্রেনীবিভাগ করে। এই শ্রেনীবিন্যাসের মাধ্যমে তারা সমকামিতা, ট্র্যান্সসহ নানা ধরণের বিকৃত ও অবাধ যৌনাচারের বৈধতা দেয়। এই অবস্থানকে হুবহু টুকলিফাই করে আমাদের কিশোরদের শেখানো হচ্ছে।
.
একইভাবে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যেকোন ধরণের যৌনতা বৈধ, গ্রহণযোগ্য এবং স্বাভাবিক –  বইয়ের আলোচনার মাধ্যমে এই শিক্ষাও শিক্ষার্থীদের সামনে আনা হয়েছে।
.
৩। বিকৃত, একপেশে ইতিহাস:  অনলাইনের আলোচনাতে এই দিকটি অন্য দুটির মতো গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু এটিও অত্যন্ত গুরুতর একটি বিষয়। কয়েকটা উদাহরণ –
.
ক) বাংলায় প্রায় ৬০০ বছরের মুসলিম শাসনকে আগেকার মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্য এবং পরের ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসনের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সবগুলোই “বিদেশীদের শাসন”, সবাই নিজেদের “ভাষা- ধর্ম-রাজনীতি এখানকার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন।”  [পৃষ্ঠা ৯৫, ষষ্ঠ শ্রেণী, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, অনুশীলন বই]
.
ব্রিটিশরা বাংলাকে শোষণ করে, এখান থেকে লুট করা সম্পদ ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছে। সিস্টেম্যাটিকালি এখানকার শিল্প ও ব্যবসা ধ্বংস করেছে। নষ্ট করেছে সামাজিক কাঠামো, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে ইচ্ছাকৃতভাবে। মোদীবাদী লজিক ছাড়া আর কিভাবে সুলতানী শাসন এবং ব্রিটিশ শাসনকে এক শ্রেনীতে ফেলে মাপা যায়, তা বোধগম্য না।
.
খ) সপ্তম শ্রেনীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে সুলতানী শাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আলোচনা করা হয়েছে। মৌর্য, গুপ্ত এমনকি ব্রিটিশ শাসনকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে সুলতানী শাসনের ট্রিটমেন্ট তার চেয়ে আলাদা।
.
যেখানে অন্য শাসনামলের ইতিবাচক দিকে বেশি ফোকাস করা হয়েছে, সেখানে মুসলিম শাসনের নেতিবাচক দিকে মনোযোগ দেয়া হয়েছে বেশি। অন্যদিকে তাদের অবদানগুলো হয়েছে উপেক্ষিত। যে সমস্যা মৌর্য, গুপ্ত, সেন এবং সুলতানী শাসন – সব আমলেই ছিল, বাকিদের বেলায় সেটা আলোচনা করা হয়নি। কিন্তু সুলতানী শাসনের দোষ সেই আলোচনা চলে এসেছে। নিরপেক্ষভাবে পড়লে যেকারো চোখে এ বৈসাদৃশ্য ধরা পড়বে।

.
গ) পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীর বইগুলোর বিভিন্ন অধ্যায়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের কথা আনা হয়েছে। কিন্তু এসব আলোচনাতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ইসলামী আন্দোলনগুলোকে। শহীদ তিতুমীর এবং ফরায়েজী আন্দোলনের কথা একেবারেই অনুপস্থিত। কোথাও কোন উল্লেখ নেই ১৮৫৭ সালের বিপ্লবে আলিমগণের ভূমিকা এবং আত্মত্যাগের।
.
অন্যদিকে বিভিন্ন শ্রেনীর বইতে বারবার কলকাতাকেন্দ্রিক বেঙ্গল রেনেসাঁ (নবজাগরণ), স্বদেশী আন্দোলন এবং ক্ষুদিরাম-সূর্যসেনদের সশস্ত্র আন্দোলনের কথা এসেছে।
.
বাংলার ইসলামী আন্দোলনের একমাত্র উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে নবম-দশম শ্রেনীর “ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা” বইতে। সেখানেও বৈষম্যটা স্পষ্ট। ফকির বিদ্রোহ, তিতুমীরের আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন এক-এক পৃষ্ঠা করেও আলোচনা পায়নি। ফরায়েজী আন্দোলনের আলোচনা টেনেটুনে দেড় পৃষ্ঠা পেয়েছে। অন্যদিকে কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁ নিয়ে এসেছে বিস্তারিত আলোচনা। প্রীতিলতাদের “সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন” নিয়ে এসেছে চার পৃষ্ঠা।
.
ঘ) ফিরিঙ্গিমুগ্ধতা: ফিরিঙ্গি বেনিয়াদের রক্তপিপাসু, নিষ্ঠুর, অসভ্য শাসকে ভালোমনদের মিশেল হিসেবে দেখানো হয়েছে। পাকিস্তান আমলের (৪৭-৭১) শাসনের আলোচনার সাথে ব্রিটিশ শাসনের আলোচনার তুলনা করলে ব্যাপারটা যে কেউ ধরতে পারবেন।
.
৪। বাংলার ইসলামী পরিচয়কে ডাউনপ্লে করা: মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের পাশাপাশি বাংলার ইসলামী পরিচয় যথাসম্ভব ডাউনপ্লে করা হয়েছে। বাংলায় ইসলামের আগমনের ইতিহাস নিয়ে আলাদাভাবে তেমন কোন আলোচনা নেই। কোন কথাবার্তা নেই খান জাহান আলী, শাহজালাল, শাহপরান, বারো আউলিয়া – কারো ব্যাপারেই।
আবার যখন ইসলামের আলোচনা করা হচ্ছে তখনও ইসলামের মূল শিক্ষার বদলে লোকজ প্রচলনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
.
.
শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষ গড়া। মানবীয় কাঁচামালকে একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে বসানো। কোন শিক্ষাব্যবস্থা কোন ধরণের মানুষ তৈরি করতে চায়, সেটাই ঠিক করে দেয় ঐ শিক্ষাব্যবস্থায় কী শেখানো হবে। আমাদের দেশের সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা এমন মানুষ তৈরি করতে চায় যে হবে কট্টর বাঙালি জাতীয়তাবাদী, কট্টর সেক্যুলার, ইতিহাসের মোদীবাদী বয়ানে বিশ্বাসী এবং পশ্চিমের অন্ধ অনুসরণকারী।
.
একারনেই পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে আমাদের শিশুকিশোরদের এমন কিছু বিষয় শেখানো হচ্ছে যা ইসলামবিদ্বেষী, মানবপ্রকৃতি বিরোধী, এবং সমাজবিধ্বংসী। নতুন প্রজন্মগুলোকে  অন্ধভাবে পশ্চিম থেকে আমদানী করা চিন্তা, মূল্যবোধ ও অবক্ষয়ের অনুসরণ করতে শেখানো হচ্ছে। পাশাপাশি ইতিহাস ও সংস্কৃতির একপেশে এবং বিকৃত দীক্ষা দেয়া হচ্ছে, যার উদ্দেশ্য আমাদের সমাজের ইসলামী পরিচয়কে মুছে দেয়া।
.
এ বিষয়টা নিয়ে আরও অনেক, অনেক কথা বলা প্রয়োজন। আরও অনেকের কথা বলা দরকার। এধরণের বিষের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী। স্রেফ সাময়িক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে এর মোকাবেলা করা সম্ভব না।

– মুহতারাম আসিফ আদনান হাফিজাহুল্লাহ

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *