গতরাতের বৃষ্টিতে আজ উঠোন জুড়ে সতেজতা বিরাজ করছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বালুগুলো যেন পরম নিশ্চিন্তে চোখ বুজেছে। ভাগ্যিস! কাল সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির পাশেই ডাস্টবিনটা পরিষ্কার করা হয়েছিল। তা না হলে উটকো গন্ধ আর আবর্জনা খিড়কি টেলে আঙ্গিনায় এসে ভিড়ত।
আজ তাই গন্ধের রেশ নেই। আছে রজনীতে প্রস্ফুটিত হাসনাহেনা ফুলের সুবাস। ফজরের আযান হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। ভোরের আলো ফুটতে এখনো অনেক বাকি। আমিনা কলপাড়ে গিয়ে দাঁত মেজে অযু করে নিল। ঘরে গিয়ে প্রতিদিনের মতো আজও তার স্বামীকে ডাকল। পরম মমতায় নামাজ পড়ার কথা বললো। কিন্তু তার কর্তা একবার ‘হু’ শব্দ করে আবারও পাশ ফিরে ঘুমালো।
আমিনার মনে আজ কিছুটা রোমান্টিকতা ভর করেছে। ঘটি থেকে খানিকটা জল এনে তার কর্তার মুখে ছিটিয়ে দিল সে। আচমকা ঠান্ডা জলের স্পর্শে কর্তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো। মেজাজ খারাপ করে উঠে আমিনার গালে বসিয়ে দিল কষে একটা চড়।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমিনা হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল। চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়তে লাগলো গতকালে ঝরা বৃষ্টির ফোঁটার মতোন।
তার স্বামী চপেটাঘাত করেই ক্ষান্ত হলো না। বাম হাতে চুলের মুঠি ধরে, ডান হাত দিয়ে মুখ টিপে ধরলো। অগ্নিঝড়া রক্তলাল চোখে তার দিকে তাকিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলতে লাগলো, “আর যদি কুনুদিন তুই নামাজের লাইগা আমার ঘুম ভাঙ্গাস, হেইদিনই তোর শ্যাষ দিন হইবো। ভুলিস না কথাডা।” বলেই ডান হাতেই এক ধাক্কা দিয়ে আমিনাকে ফেলে দিল।
মাটিতে রাখা লোহার সিন্দুকের উপর গিয়ে পড়ল তার কপাল। ফেটে যায়নি, চোখের উপর ডান ভ্রু’র কিছুটা উপরের দিকটা চিনচিন করে উঠল।
আর কোনো কথা না বলে উঠে গিয়ে নামাজ পড়ে নিল আমিনা। নামাজ শেষ করে উঠোন ঝাড় দিয়ে সে ভাত-তরকারি রান্না করে তার কর্তার জন্য টেবিলে সাজিয়ে রাখলো।
হাফসা আপার বাসায় কাজে যাওয়ার আগে ছোট একটি আয়নায় নিজেকে দেখে নিল সে। দেখল, কপালের ঐদিকটা ফুলে উঁচু টিলার মতো হয়ে আছে। “মীম” জিজ্ঞেস করলে সে কী বলবে! ভেবেই লজ্জা লাগলো তার। সে চিন্তা করেছে মীমের সামনে ঐ জায়গাটা খুব ভালভাবে ঢেকে রাখবে। তা না হলে এই পিচ্চির প্রশ্নবাণে তাকে আত্মাহুতি দিতে হবে।
. . . কলিংবেলের আওয়াজে হাফসা দরজা খুললো। আজ সে-ই আগে আমিনাকে সালাম দিয়েছে। সালাম দিতে জিতে যাওয়ায় সে হেসে ফেলল। আমিনা সালাম নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।
শ্যামলা কিন্তু মায়াবী চেহারা, নয়নজোড়াতেও মায়ার মাখামাখি, দীঘল লম্বা চুলের বেণী কাঁধ বেয়ে সাপের মতো হাঁটুতে নেমে এসেছে। গজদাঁতের হাসিটাও মনোমুগ্ধকর। সৃষ্টিকর্তা তাকে শুধু গায়ের রংটাই দেননি। এছাড়া আর কোনো কিছুরই কমতি নেই তার, আলহামদুলিল্লাহ।
“আপা, মীম কই?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আমিনা। “আমাদের রুমের মেঝেতে খেলছে। এসে দেখে যাও।” আবারও হাসলো হাফসা। এই মেয়েটা সবসময়ই হাসে।
তাকে খুব ভালোলাগে আমিনার। এই বাসায় আসলে সে ভুলেই যায় তার পীড়িত জীবনের কথা। আপা তাকে নিজের বোনের মতোই ভালবাসেন।
তার মেয়ে মীমের বয়স ২.৫ বছর। মেয়েটাও তাকে খুব ভালোবাসে। আমিনাও কম ভালোবাসে না। মীমের উচ্চারণ ততটা শুদ্ধ নয়। আধো আধো বুলিতে তার কথাগুলো মনে বইয়ে দেয় আনন্দের ফোয়ারা। আমিনাকে সে ডাকে “আম্না”। এই ডাকই আমিনার খুব ভাললাগে।
. . . হাফসার পিছু পিছু তাদের শোবার ঘরে গিয়ে দেখে পুতুলটা খেলছে। “মীম” বলে ডাকতেই, আমিনাকে দেখে পিচ্চি এমন খুশি হয়েছে, যেন হারানো কোনো খেলনা ফিরে পেয়েছে। “আম্না! আম্না!” বলেই খেলা ছেড়ে সে থপ থপ করে আনাড়ি পা ফেলে তার দিকে ছুটে আসছিল।
আমিনা আরেকটু এগিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেল।
হাফসা সোফায় বসে চা খাচ্ছিল। আমিনার জন্যও এক কাপ আর বিস্কুট এনে রেখেছে। অনেক কষ্ট করে সে আমিনার সংকোচ কাটিয়েছে। আমিনাকে বললো, ” ওরে নিয়ে থাকলে তোমার আর চা খেতে হবে না। চায়ের স্বাদে ঠান্ডা পানি খেও।”
মীমকে কোলে নিয়েই সে চা’য়ের কাপ হাতে নিল। মেঝেতে বসতে ধরতেই হাফসা চোখ পাকালো। তারপর সে উঠে এসে হাফসার পাশেই বসলো। তারপর সকালে নাস্তা সেরে নিল দু’জনেই।
. . . আজ রান্না শেষে সে বাড়ি যাবার জন্য দরজার কাছে আসতেই মীম হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই সে আধোবুলিতে বললো, “আমি তোমাত তাতে তোমাল বাতায় দাবো(আমি তোমার সাথে তোমার বাসায় যাব)।”
আমিনা হাফসার দিকে তাকাতেই সে নিয়ে যেতে বললো। আমিনা খুশি হয়ে পিচ্চিকে কোলে তুলে নিয়ে বললো, বিকেলেই সে মীমকে রেখে যাবে।
রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় মীম বায়না ধরলো হাঁটবে বলে। আমিনা তাকে কোল থেকে নামিয়ে আলতো করে হাত ধরে রাখলো। রাস্তার একপাশ দিয়ে তারা হাঁটছে। এমন সময় একটা সুন্দর প্রজাপতি উড়ে যাচ্ছিল মীমের সামনে দিয়ে। তার ধরে রাখা হাতটা ঝাঁকিয়ে সে আমিনার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। ঐ হাত দিয়েই সে প্রজাপতি দেখাচ্ছিল আমিনাকে।
আমিনা কিছু বুঝে উঠার আগেই মীম সড়কের মাঝখানে চলে গিয়েছে। একটা দ্রুতগামী ট্রাক আসছিল ঐদিক থেকে। আমিনা কি করবে ভেবে না পেয়ে সে-ও দৌড়ে সড়কের মাঝে চলে গেল। ট্রাকটি কাছাকাছি আসতেই সে সজোরে মীমকে ধাক্কা দিল। মীম গিয়ে পড়লো রাস্তার পাশে ঘাসের উপর।
আমিনা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রইলো রাস্তায়। বাজারের কিছু লোক দৌড়ে এলো। মীমদের বাসাও বেশিদূরে ছিল না। হাফসা তার স্বামীকে নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে আমিনার রক্তাক্ত দেহের পাশে বসে পড়লো। আর তার পিছনে মীমের বাবা মীমকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমিনা শেষবার মীমের দিকে তাকিয়ে ঐ যে চোখ বুজলো; আর খোলেনি।