ওই সে আসছে! যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের মারিওপোলের বাসিন্দারা তাকে দেখতে পাচ্ছেন স্পষ্ট। সে, অর্থাৎ মৃত্যু। রাশিয়ার হামলায় অবরুদ্ধ মারিওপোলে বসে এক নারী সেই আগত মৃত্যুরই ধারাবিবরণী দিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। লিখেছেন, ‘আমি নিশ্চিত, খুব তাড়াতাড়ি আমি মরতে চলেছি। আর মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার। এই শহরের প্রতিটি মানুষ সেই মৃত্যুরই প্রতীক্ষায়’।আজভ সাগরের তীরে মারিওপোলকে চার দিক থেকে ঘিরে ধরে লাগাতার হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। বন্ধ জল, খাদ্য, পরিবহণ থেকে শুরু করে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই। চারদিকে কেবল রুশ হামলায় তছনছ শহরের ধ্বংসস্তূপ আর অসহায় শহরবাসীর কান্নার আওয়াজ। মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে থাকা মারিওপোলের তেমনই এক বাসিন্দার মর্মস্পর্শী পোস্ট পড়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারছে না বিশ্ব। ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘চার দিকে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। বারান্দায় বসে দেখতে পাচ্ছি, মৃত্যু আসছে। আসুক, কিন্তু তা যেন খুব বেশি যন্ত্রণাদায়ক না হয়, এটাই প্রার্থনা’।ইউক্রেনে হামলার প্রথম পর্যায়েই আজভের তীরে অবস্থিত মারিওপোল দখলকে প্রাধান্য দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। চার দিক থেকে ঘিরে ধরে চলছে লাগাতার হামলা। এখনও পর্যন্ত রাশিয়ার হামলায় শহরের ২৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেন সরকার। শহরের মধ্যেই গণকবরে চিরবিদায় জানানো হয়েছে তাদের। বাকিরা দিন গুনছেন, কবে মৃত্যু আসবে।যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই নারী লিখেছেন, ‘আমার উঠোনটায় কতই না গল্প লুকিয়ে আছে। কিন্তু এখন তাতে অপার শান্তি আর অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কালো ছায়া। গোটা উঠোনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছাই, কাচের ভাঙা টুকরো আর লোহা লক্কর। আমি উঠোনের দিকে তাকাতে চাইছি না। কিন্তু চোখ চলে যাচ্ছে। কিছু বড় বড় লোহা পড়ে আছে দেখছি, মনে হয় ওইগুলো রকেট। সাধের উঠোনটিকে এ ভাবে দেখতে পারছি না’।ওই নারীর দাবি, গোটা শহরে সম্ভবত তার বাড়িটিই একমাত্র যেখানে সরাসরি এখনও কোনও রকেট এসে পড়েনি। তিনি লিখেছেন, ‘দিনের বেলায় আমি বাইরে বারান্দায় গিয়ে বসি। চার দিকে শ্মশানের নীরবতা। রাস্তায় গাড়ি নেই। পার্কে বাচ্চাদের চিৎকার নেই। বেঞ্চগুলোও ফাঁকা। বড়রা যে কোথায় গেলেন! আমার তো মনে হচ্ছে শহরের বাতাসটাও মরে গিয়েছে’। মৃত্যুকেও প্রতি মুহূর্তে খুব কাছ থেকে দেখছেন তিনি। লিখেছেন, ‘এখানে ওখানে কিছু মানুষ পড়ে আছে। পার্কিং লট, বাড়ির বাইরের উঠোন- সব জায়গাতেই কাপড়ে ঢাকা দেহ। আমি ও দিকে চেয়ে থাকতে পারি না। কি জানি, চেনা কাউকে মরে পড়ে থাকতে দেখে ফেলি কি না!’ আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর মারিওপোল নিয়ে গভীর শংকারাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সারা বিশ্বের প্রধান নজর এখন বন্দর শহর মারিউপোলের দিকে। কৌশলগত-ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই শহরের নিতে মরিয়া হয়ে পড়েছে রুশ সৈন্যরা।গত প্রায় দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় সময় অবরোধ করে রাখা এই শহরে অব্যাহত গোলাবর্ষণের পর গত রবিবার রাতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় লড়াইরত ইউক্রেনিয়ান সৈন্য এবং মাারিউপোল নগর সরকারকে সোমবার মস্কো সময় ভোর পাঁচটার মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বলে।পরিবর্তে শহরের বাসিন্দা এবং ইউক্রেনিয়ান সৈন্যদের দুটো নিরাপদ করিডোর দিয়ে চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু ইউক্রেন সরকার এবং মারিউপোলের স্থানীয় প্রশাসন আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলে জানা গেছে।ইউক্রেনের উপ প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে সেদেশের সংবাদ মাধ্যম ইউক্রোনিস্কা প্রাভদা বলছে, ‘আত্মসমর্পণের বা অস্ত্র সমর্পণের কোনো প্রশ্নই ওঠেনা’।মারিওপোল শহরের মেয়রের একজন উপদেষ্টা বিবিসিকে বলেছেন, নিরাপদে চলে যাওয়ার যে প্রতিশ্রুতি মস্কো দিয়েছে তার ওপর বিশ্বাস করা যায়না এবং শেষ সৈন্য বেঁচে থাকা পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে।আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর রাশিয়া এখন কী করবে, মারিওপোল শহর এবং সেখানে আটকে পড়া লাখ তিনেক বাসিন্দার কপালে কী করবে তা নিয়ে গভীর আশংকা তৈরি হয়েছে।কারণ পানি, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন এবং বোমায় বিধ্বস্ত এই শহরে এখনো তিন লাখের মত লোক রয়েছে বলে বলা হচ্ছে।আত্মসমর্পণ না করলে রুশ সৈন্যরা কী করবে তা এখনো স্পষ্ট করেনি মস্কো। মারিউপোলে রুশ সৈন্যদের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকেই এখন সবাই তাকিয়ে রয়েছে। ‘পৃথিবীর বুকে নরক’মারিওপোলের মানবিক পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে মারিওপোলের এমপি ইয়ারোস্লাভ জেলেজনিয়াক বলেন তার শহর এখন কার্যত ‘পৃথিবীর বুকে নরক’।পুরো শহরটি ঘিরে রয়েছে রুশ সৈন্যরা। বিদ্যুৎ নেই, পানি সরবরাহ নেই। খাবার এবং ওষুধের মজুদ খুবই কম মানুষ খাবার কষ্টে ভুগছে এবং রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।স্থলপথ ছাড়াও আকাশ এবং সাগর থেকে দিনের পর পর রুশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং গোলা এসে পড়ার কারণে অধিকাংশ মানুষ এখন ঠাণ্ডা-অন্ধকার বোম-শেল্টার এবং বেজমেন্টের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে রয়েছে।আর রুশ সৈন্যদের সাথে ইউক্রেনিয়ান যোদ্ধাদের মুখোমুখি লড়াই এখন মারিওপোল শহরের কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে। ফলে শহর থেকে পালানোর সুযোগও চলে যাচ্ছে।স্যাটেলাইট এবং অন্যান্য সূত্রে মারিওপোলের যেসব ছবি এবং ভিডিও প্রকাশ পাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে পুরো শহরটি কার্যত একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।গত সপ্তাহের শহরের মেয়র ভাদিম বোভচেঙ্কো বিবিসিকে বলেন শহরের ৮০ শতাংশ আবাসিক ভবন হয় বিধ্বস্ত হয়েছে না হয় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।তিনি বলেন, রাস্তায়, রাস্তায় মরদেহ পড়ে রয়েছে, কিন্তু বোমা এবং গুলির ভয়ে সেগুলো সৎকারের ব্যবস্থা করা যাচ্ছেনা। রুশ একজন জেনারেল পর্যন্ত বলেছেন মারিওপোলের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে।তবে রাশিয়ানদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে এই পরিস্থিতির প্রধান দায় ইউক্রেনীয়, মস্কোর ভাষায়, কট্টর জাতীয়তাবাদীদের। তারাই বেসামরিক মানুষজনকে নিরাপদে চলে যেতে দিচ্ছেনা, জিম্মি করে রেখেছে। কেন মারিওপোলের দখল নিতে মরিয়া রাশিয়ামারিউপোলের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার জন্য কৌশলগতভাবে বড় একটি বিজয় হবে। কারণ এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ পেলে স্থলপথে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়ার সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হবে। ইউক্রেনে যুদ্ধরত রুশ সৈন্যদের জন্য রসদ সরবরাহ করাও অনেক সহজ হবে রাশিয়ার জন্য।

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করে পাঠকের কাছে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য সংবাদ পৌঁছে দেয়। তারা ঘটনার প্রকৃত তথ্য ও বিশ্লেষণ তুলে ধরে যাতে পাঠক বিস্তৃত ও স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারেন। নিজস্ব প্রতিবেদকদের লক্ষ্য হলো দ্রুত এবং নিখুঁত প্রতিবেদনের মাধ্যমে সমাজে তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।