জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বিপন্ন একটি দেশের চরম এক আকুতি শোনা গেল। প্রবল ঝুঁকিতে থাকা দ্বীপরাষ্ট্র পালাউয়ের প্রেসিডেন্ট সুরাঙ্গেল হুইপস জুনিয়র বলেন, ধীরে ধীরে ভুগে ভুগে মারা যাওয়ার কোনো মর্যাদা নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের আসন্ন বিপদের মানে হচ্ছে, এর চেয়ে তাঁদের ওপর বোমা ফেলাও ভালো। আর সম্মেলনস্থলের বাইরে ছিল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ধনী দেশগুলোর ব্যর্থতার নানা চিত্র তুলে ধরে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। গ্লাসগো শহরের কেন্দ্রস্থলে বিক্ষোভকারীরা তাঁদের অভিনব এসব প্রতিবাদ দ্বিতীয় দিনের মতো গতকাল মঙ্গলবারও অব্যাহত রাখেন। গতকাল দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে প্রায় ৬০ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের বক্তব্য দেওয়ার কথা। তবে দূষণের শীর্ষে থাকা শিল্পোন্নত দেশগুলোর নেতারা সম্মেলনের প্রথম দিনে নিজ নিজ দেশের অঙ্গীকারের কথা তুলে ধরেন।
নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন থেকে কোনো যৌথ রাজনৈতিক ঘোষণা দেওয়া হবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। তবে ইতিমধ্যেই গত সোমবার রাতে চলতি দশকের মধ্যে বিশ্বে বন উজাড়করণ বন্ধের বিষয়ে এক সমঝোতার কথা ঘোষণা করা হয়। এবারের জলবায়ু সম্মেলন কপ ২৬-এ এটিই প্রথম কোনো বিষয়ে সমঝোতা। বিশ্বের বৃহত্তম বনসম্পদ আমাজনের ক্ষয়সাধনের জন্য বহুল সমালোচিত ব্রাজিলের জনতুষ্টিবাদী প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর সরকার এই চুক্তিতে অংশ নেওয়ায় একে একটি বড় অগ্রগতি বলে মনে করা হচ্ছে। চুক্তিতে সম্মত হওয়া শতাধিক দেশ এ জন্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার তহবিল জোগান দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বনায়ন প্রকল্পে বিনিয়োগের উদ্যোগের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। কপ ২৬ প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে জানানো হয় যে ১১৪টি দেশের নেতারা বন উজাড়করণ রোধ চুক্তিতে সই করেছেন। প্রকাশিত তালিকায় অবশ্য বাংলাদেশ নেই।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে ২০১৪ সালেও এ বিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু তা প্রতিপালিত হয়নি। এমনকি অভিযোগ রয়েছে, ব্রাজিলে আমাজনের প্রায় ১২ শতাংশ বিনাশ করা হয়েছে। গাছ কেটে বন ধ্বংস করা হলে তা জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে। কারণ, এর ফলে কার্বন গ্যাস শুষে নেওয়ার পরিমাণ কমে যায়। কপ ২৬ এবং তার বাইরে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জোট সিভিএফের সদস্যদের স্বার্থ, উদ্যোগসমূহ ও প্রত্যাশার বিষয়ে জোটের সভাপতি বাংলাদেশের নেতৃত্বে আয়োজিত এক সভায় ঢাকা-গ্লাসগো ঘোষণাও গৃহীত হওয়ার কথা জানিয়েছে কপ প্রেসিডেন্টের দপ্তর। তবে ঘোষণার বিস্তারিত তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। জলবায়ু সম্মেলন ঘিরে যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা করা হচ্ছিল, সেটি হচ্ছে চলতি শতকে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে ২০৫০ সালে ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ ও বায়ুমণ্ডল থেকে সমপরিমাণে তা অপসারণের মাধ্যমে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা বা নেট জিরো অর্জনে সব দেশের দৃঢ় অঙ্গীকার।
কিন্তু গত সোমবার বিশ্বের বর্তমান কালের শীর্ষ দূষণকারীদের মধ্যে চীন ও ভারত যে ঘোষণা দিয়েছে, তাতে মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়, অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশ আরও বেশি পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ না কমালে ২০৫০-এর নেট জিরো অর্জিত হবে না। বিশ্বের শীর্ষ দূষণকারী দেশ চীন আগেই জানিয়েছিল যে তাদের লক্ষ্য ২০৬০-এ নেট জিরো অর্জন এবং গত সোমবার সম্মেলনে দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের যে বক্তৃতা পড়া হয়েছে, তাতে ওই লক্ষ্যমাত্রায় কোনো পরিবর্তন নেই। আর চতুর্থ শীর্ষ দূষণকারী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন, তাঁর দেশ ২০৭০ সালে নেট জিরো অর্জন করবে।
পরিবেশবাদী ও রাস্তার বিক্ষোভকারীরা এসব ঘোষণায় হতাশ হলেও সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী রাজনীতিকেরা একে বলছেন মন্দের ভালো। চীন ও ভারতের এই ঘোষণার পর কপ ২৬-কে সফল বলা যাবে কি না, প্রথম আলোর এই প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এমন মন্তব্যই করেছেন। তবে তিনি বলেন, ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রস্তুতি বা অভিযোজনের জন্য বার্ষিক যে ১০ হাজার কোটি ডলার সহায়তার অঙ্গীকার আছে, তা প্রতিপালনের সিদ্ধান্ত হলে, সেটিকে একটি ভালো অর্জন বলতে হবে।
বিক্ষুব্ধ পরিবেশবাদীরা এই মন্দের ভালোতে যে মোটেও সন্তুষ্ট হবেন না, তা মোটামুটি স্পষ্ট। গত সোমবার রাতে কেলভিনগ্রোভ আর্ট গ্যালারি অ্যান্ড মিউজিয়ামে বিশ্বনেতাদের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজের আয়োজনের পাশেও চড়া স্বরের বিক্ষোভ হয়েছে। গ্লাসগোর কেন্দ্রস্থলে তরুণদের অন্য আরেকটি প্রতিবাদী আয়োজনে সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ বলেছেন, নেতারা সব ভান করছেন, তাঁরা আদৌ আন্তরিক নন। গতকালের বিক্ষোভ আয়োজনগুলোতেও বিশ্বনেতাদের অবয়বসংবলিত কার্টুনচিত্রের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সম্মেলনকেন্দ্রের কাছে ক্লাইড আর্কে নেতাদের কাটআউট দিয়ে নেটফ্লিক্সের স্কুইড গেমের প্রতীকী রূপায়ণ করা হয়। স্কুইড গেমে বড় ধরনের জুয়াতে শিশুদের আকৃষ্ট করার যে কাহিনি দেখানো হয়, এই বিক্ষোভকারীরা পুঁজিবাদের সেই লিপ্সার দিকটিতেই আলোকপাত করেন। আর আমেরিকান ব্যাংক জে পি মরগানের দপ্তরের সামনে এক্সটিংশন রেবেলিয়নের শ দুয়েক বিক্ষোভকারী অবস্থান নেন। তাঁদের দাবি, জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে অন্যতম বড় বিনিয়োগকারী জে পি মরগানকে অবিলম্বে এই খাতে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে।
স্কটিশ ইভেন্ট সেন্টার, এসইসির বিশাল এলাকার এক পারে গ্রিন জোনে চলছে জলবায়ু সম্মেলনের মূল আয়োজন এবং বিভিন্ন গ্রুপে বিশেষজ্ঞদের আলোচনা ও দর-কষাকষি। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার নিজস্ব প্যাভিলিয়নে আলাদা আলাদা আয়োজনে একই সঙ্গে চলছে সভা ও সেমিনার। গতকালও সম্মেলনকেন্দ্রে প্রবেশের জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা যায় এবং নিরাপত্তা আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়। রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং মন্ত্রীদের জন্য অবশ্য সরাসরি ঢোকার ব্যবস্থা আছে। নদীর অপর পারে ব্লু জোনে চলছে নতুন ও দূষণমুক্ত প্রযুক্তির প্রদর্শনী ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক উদ্যোগের আলোচনা।