আগামী ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। এ নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেছে সব মহল। তবে এরই মধ্যে উদ্বেগের জায়গা তৈরি করেছে- বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের বিষয়টি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ বলা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। গত ২০ সেপ্টেম্বর ১৬০ ইউপি নির্বাচনের আগেই ৪৩ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ ঘটনা ‘নির্বাচন ব্যবস্থাকে ম্লান করে দিয়েছে’ বলে দাবি করেছেন সে সময়ে দায়িত্বে থাকা ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এ থেকে উত্তরণে ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো দায় চাপানোয় ব্যস্ত। বিরোধীরা বলছেন, ‘সবকিছু সরকারি দলের হাতে’। অবস্থা থেকে উত্তরণে তাদের সদিচ্ছা প্রয়োজন। অন্যদিকে সরকারি দলের নেতারা বলছেন, নির্বাচনে অংশ না নেওয়াও গণতান্ত্রিক অধিকার। কেউ না এলে তো জোর করে আনা যায় না! ৪৩ ইউপিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের বিষয়ে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ইউনিয়ন পরিষদে ৪৩ জন প্রার্থী নির্বাচন না করেই চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত হওয়া এই নির্বাচনকে ম্লান করে দিয়েছে। অন্যদিকে ৯টা পৌরসভার তিনটিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হওয়াকে নির্বাচিত হওয়া বলা যায় কি?
তিনি আরও বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের কারণ বিশ্লেষণ করে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ অনিবার্য। ভোটারদের নির্বাচনবিমুখতাও আমার কাছে গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত মনে হয়। এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনা জড়িত। এ অবস্থা থেকে সার্বিকভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার রংপুর ডেইলীকে বলেন রাজনৈতিক সমঝোতা হলে অবশ্যই একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম হবে নিঃসন্দেহে। তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনেও নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও সৎ ব্যক্তিরা আসবেন। এখন যেটা ঘটছে, নির্বাচন কমিশনে পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিরা নিয়োগ পেয়ে তারা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকারে দলভিত্তিক নির্বাচনের ফলে যারাই ক্ষমতাসীনদের মনোনয়ন পায়, পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় তারাই নির্বাচিত হয়ে যান। যে জন্য মানুষ নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক সমঝোতা দরকার এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা বাড়াতে হবে।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা’র সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন বলতে কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই। নির্বাচন মানেই হচ্ছে, বেশ কয়েকটা দল অংশ নেবে, প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবে, ভোট দেবে। এরপর সঠিকভাবে ভোট গণনা করে মানুষের ইচ্ছার যে প্রতিফলন, সেটি ভোটের ফলাফলে দেখতে পাবে। তার কোনোটিই বাংলাদেশে এখন আর নেই। স্থানীয় সরকার বা জাতীয় সংসদ, বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনই নেই।
তিনি আরও বলেন, আমরা কেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যবস্থা করে দেবো? বিবিসির রেকর্ড বলছে, যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী অথবা যারা ছোট ছোট দল থেকে মনোনয়ন নিয়ে আসছে, ইউপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য, তাদেরও নির্বাচনের আগে ভয়ভীতি, প্রলোভনসহ নানান কিছু দেখিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা হয়েছে। তাদের ভোটও কেড়ে নিয়ে জালিয়াতি করে নৌকা মার্কায় সিল দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরা হয়েছে। এখন আর নির্বাচন বলে কিছু নেই। পুরোটাই বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে তামাশা এবং হাস্যকর বিষয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের বিষয়ে তিনি বলেন, এ থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে- সরকারকে বুঝতে হবে, এভাবে ভোট ও অধিকারসহ সবকিছু লুটের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় থাকা যায় না। একটা নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির জন্য যা যা দরকার, সেটা সরকারকেই করতে হবে। কারণ রাষ্ট্র ও প্রশাসন যন্ত্র সরকারের হাতে। এমনকি নির্বাচন কমিশন চাইলে যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে, তাও না। সেটাও সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সরকারের সদিচ্ছা যদি না থাকে তাহলে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ মনে করেন, শত বছর ধরেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার নজির আছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মতো না নেওয়াও এক ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার। এ নিয়ে তিনি রংপুর ডেইলীকে বলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হওয়ার বিধান সারা পৃথিবীতেই আছে। বাংলাদেশেও আছে। গত একশ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ প্রতিটি নির্বাচনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার অনেক নজির আছে। প্রতিপক্ষের কেউ যদি মাঠে না থাকে, প্রার্থী না হয়, সেক্ষেত্রে একজন প্রার্থী থাকলে সে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতেই পারে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার, অংশ না নেওয়াও এক ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার।
তিনি বলেন, কাউকে কি জোর করে বলতে হবে, ভোটে দাঁড়াও! এটা তো বিধান হতে পারে না। আমরা তো সবাই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছি। কেউ যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না চায় বা কোনো এলাকায় যদি একজন ব্যক্তির ওপর আস্থা রেখে অন্যরা ছেড়ে দেয়, এটা দোষের কী আছে? অনেক নজির তো আছে। এলাকার একজন গণমান্য ব্যক্তি, সমাজের সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি যদি নির্বাচনে দাঁড়ান- সবাই মিলে বলেন যে, উনি ভালো মানুষ, সবাই ওনাকে চান। এজন্য তার সম্মানার্থে কেউ হয়তো প্রার্থী হলো না, এটা হতেই পারে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় চায় রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকুক। এখন কেউ যদি নির্বাচনে না আসে আমাদের করণীয় কী? আমরা তো রাজনৈতিক দল, নিয়ন্ত্রক সংস্থা না। যেসব রাজনৈতিক দল আছে, সবার উচিত নির্বাচনে অংশ নেওয়া। বিএনপি নির্বাচনে না এলে আমরা ধরে-মেরে-যেচে তো আনতে পারি না।
‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো ভূমিকা নেই। এটা তো স্থানীয় সরকারের একেবারেই তৃণমূল পর্যায়ের বিষয়। সেখানে নির্বাচন অনেকটা স্থানীয়কেন্দ্রিক। ওই পর্যায়ের নেতারা যদি নিজেরাই সমঝোতায় আসেন বা নিজেরা যদি নির্বাচন করতে না চান, সেখানে আমাদের করণীয় কিছু নেই। বরং আমরা চাই সব জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হোক।’ তিনি আরও বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থা অকার্যকর করতে চায় বলেই বিএনপি নির্বাচনে আসছে না। আজ তারা মাঠে থাকলে তো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। তাদের তো গণতন্ত্রের জন্য আন্তরিকতা নেই। আন্তরিকতা থাকলে আসতো। তারা নির্বাচনী ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে না। ষড়যন্ত্র করে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে পুঁজি করে কীভাবে ক্ষমতায় যেতে হবে, সেটায় তারা বিশ্বাসী। তারা বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল, মানুষের বা ভোটের ওপর না। এজন্য তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আসছে না।