তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদের পারিবারিক সম্পত্তির অধিকার ও আমাদের সাংবিধানিক দায়

বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের মধ্যে, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা সেবা সহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারের বিবেচনায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা অন্যতম। মুল জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন এ সম্প্রদায়ের প্রতি সাধারণ মানুষের অবহেলা ও বৈষম্যও লক্ষণীয়। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মানবেতর জীবন যাপন যেকোনো সভ্য মানুষের হৃদয়ে হাহাকার সৃষ্টি করে।

সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা দশ হাজার হলেও, হিজড়াদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য মতে বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ(Gayle, D.2014, 11 November)। হিজড়াদের প্রতি বৈষম্য দূর করার লক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালের নভেম্বরে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়।

হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয়ার পর ৬-৭ বছর অতিবাহিত হলেও তারা এখনও পারিবারিক সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী” । সংবিধানের ২৮ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষ-ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না” এবং ৪১ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জনের অধিকারের কথা। সংবিধানে বৈষম্য বিলপের কথা থাকলেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা পারিবারিক সম্পত্তির অধিকার থেকে এখনও বঞ্চিত।

কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদের পারিবারিক সম্পত্তি পেতে সব চেয়ে বড় বাধা আইন। বাংলাদেশে কোন আইনেই তাদের বাবা-মায়ের সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার প্রশ্নে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মের অনুসারিদের মধ্যে সম্পত্তির ভাগ হয়ে থাকে তাদের ধর্ম অনুসারে। বাংলাদেশে ১৯৬১ সালের মুসলিম উত্তরাধিকার আইন কার্যকর রয়েছে, কিন্তু সেখানে হিজড়াদের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে সরাসরি কিছু বলা নেই। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে সন্তানদের কথা বলা আছে। এ আইন অনুসারে কেবল নারী ও পুরুষ পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ পান। হিন্দু আইনেও হিজড়াদের পারিবারিক সম্পত্তি পাওয়ার বিষয়ে কিছুই বলা নেই। এমনকি হিন্দু আইন অনুসারে নারী সন্তানরা বাবার সম্পত্তি পান না । এছাড়াও খৃস্টান সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পারিবারিক সম্পত্তির কিছু বিধি বাংলাদেশে কার্যকর থাকলেও সেগুলোতে হিজড়াদের উত্তরাধিকার সম্পর্কে কিছুই বলা নেই। আশার কথা হল, আওয়ামীলীগ সরকার হিজড়াদের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি, ভোটাধিকার, সম্পত্তি ক্রয়, সরকারি চাকরিতে যোগদান, শিক্ষা, ভাতা সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও বৈষম্য দূরীকরণ প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার।

গত ৯ নভেম্বর ২০২০ মন্ত্রীসভার বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রি হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বিদ্যমান আইন এবং সংবিধানের আলোকে একটা সমাধান বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে হিজড়া সম্প্রদায় উত্তরাধিকার সুত্রে তাদের সম্পত্তি পান।

বাংলাদেশে বিদ্যমান যে সংবিধান ও আইন আছে তাতে নাগরিকদের মাঝে বৈষম্য দূরীকরণ, সম্পত্তির অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সমতার কথা বলা হলেও হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের পারিবারিক ও পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করণ নিয়ে সরাসরি কোনও কথা বলা নেই। যার ফলশ্রুতিতে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী সম্পত্তির অধিকার চাইতে গেলে আইনের মার প্যাচে হেরে যান। তা ছাড়া সামাজিক ভাবে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি না থাকার কারনে তাদের পিতা মাতাও তাদের সম্পত্তির অধিকার দিতে আগ্রহি নয়। একদিকে পারিবারিক বৈষম্য অন্যদিকে সামাজিক নিপীড়নের কারনে তারা বেছে নিচ্ছেন বিভিন্ন সমাজ বহির্ভূত কাজ।

যেহেতু আমাদের সংবিধান সকল নাগরিকদের সমান অধিকারের কথা বলে , এবং হিজড়াদের আমরা তৃতীয় লিঙ্গের মর্যাদা দিয়েছি, এবং বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান কার্যকর থাকা ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সম্পত্তি বণ্টন আইন থাকা সত্তেও হিজড়া জনগোষ্ঠী তাদের সম্পত্তির অধিকার তথা মানবাধিকার থেকে বঞ্ছিত , সেহতু বিদ্যমান বা প্রচলিত আইনে এ সমসসার সমাধান খোজা খুব একটা কার্যকর নাও হতে পারে।

যেহেতু আমাদের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ছিল একটি শোষণহীন, নিপীড়নহীন ও বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, এবং ক্ষুদ্র হলেও হিজড়া জনগন আমাদের সমাজেরই অংশ, সেহতু আমাদের উচিত হিজড়াদের প্রতি সকল বৈষম্য দূর করে তাদের মুল জনগোষ্ঠীর সাথে একীভূত করা। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের পাশাপাশি হিজড়া জনগোষ্ঠীদের পারিবারিক সম্পত্তি নিশ্চিতকরণ সহ অন্যান্য মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে নতুন আইন পাস করার দিকে নজর দিতে হবে। সর্বোপরি সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগনের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হতে পারে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদের পারিবারিক সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠিার মোক্ষম অস্ত্র।

শাহাদাত হোসেন শামিম

By নিজস্ব প্রতিবেদক

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *