তাকওয়া এবং তার উকারিতা

তাকওয়া এবং তার উকারিতা, তাকওয়া শব্দের অর্থ বিরত থাকা, বেঁচে থাকা, ভয় করা, নিজেকে রক্ষা করা। ব্যবহারিক অর্থে পরহেজগারি, খোদাভীতি, আত্মশুদ্ধি ইত্যাদি বোঝায়।

ইসলামি পরিভাষায় আল্লাহ তায়ালার ভয়ে যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার ও পাপকাজ থেকে বিরত থাকাকে তাকওয়া বলা হয়। অন্যকথায় সকল প্রকার পাপাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করাকে তাকওয়া বলা হয়।[১]

আল্লাহ কুরআনে মুমিন বান্দাদেরকে তাকওয়া অর্জনের অসিয়ত করেছেন। তিনি কুরআনে বলেন,

 

﴿وَلَقَدۡ وَصَّيۡنَا ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ مِن قَبۡلِكُمۡ وَإِيَّاكُمۡ أَنِ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ وَإِن تَكۡفُرُواْ فَإِنَّ لِلَّهِ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ غَنِيًّا حَمِيدٗا ١٣١ [النساء: ١٣١]

“আর তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমি নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর যদি কুফরি কর তাহলে আসমানসমূহে যা আছে এবং যা আছে জমিনে সব আল্লাহরই। আর আল্লাহ অভাবহীন, প্রশংসিত।” [সূরা নিসা: (১৩১)]

তাকওয়া এবং তার উকারিতা

তাকওয়া এবং তার উকারিতা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও হাদিসে উম্মতকে তাকওয়া অর্জনের উপদেশ দিয়েছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:

فعن أبي أمامة صُدى بن عجلان الباهلي قال: سمعت رسول الله يخطب في حجة الوداع فقال: {اتقوا ربكم وصلّوا خمسكم، وصوموا شهركم، وأدّوا زكاة أموالكم، وأطيعوا أمراءكم، تدخلوا جنة ربكم}.

আবু উমামা সুদাই ইবনু আজলান আল-বাহেলি বলেন: আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিদায়ী হজে খুতবা দিতে শুনেছি। তিনি বলেন: “তোমরা তোমাদের রবের তাকওয়া অর্জন কর, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় কর, তোমাদের রমযানে সিয়াম পালন কর, তোমাদের সম্পদের জাকাত আদায় কর, তোমরা তোমাদের নেতাদের অনুসরণ কর, অতঃপর তোমরা তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ কর।” 

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 

“তাকওয়া এখানে,” এরপর তিনি তাঁর বুকের দিকে তিনবার আঙ্গুল দিয়ে দেখান। [২]

নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“তুমি যেখানেই থাকো না কেন, তাকওয়া (আল্লাহকে ভয়) অবলম্বন করো এবং একটি খারাপ কাজ করে ফেললে সাথে একটি ভাল কাজও কর। সেটা খারাপ কাজটিকে মুছে দেবে। আর মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করবে।” [৩]

আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“পূণ্য হচ্ছে সচ্চরিত্র। আর পাপ হচ্ছে যা তোমার (অন্তরে) খটকা সৃষ্টি করে এবং লোকে তা জানুক তা তুমি অপছন্দ কর।” [৪]

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“তাকওয়া হল আল্লাহর শাস্তির বিরুদ্ধে ঢালস্বরূপ।”[৫]

এই হাদিসগুলোতে ইমান ও চরিত্রের অপরিহার্য দিক হিসেবে তাকওয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে যে, তাকওয়া নির্দিষ্ট কর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি চেতনার এমন একটি অবস্থা যা একজন মুমিনের জীবনের প্রতিটি দিককে পরিব্যাপ্ত করা উচিত। এটি পাপের বিরুদ্ধে ঢাল এবং ধার্মিকতা ও উত্তম চরিত্র অর্জনের একটি উপায় হিসাবে কাজ করে। তাকওয়ার মাধ্যমে, একজন ব্যক্তি আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক শুদ্ধ করতে পারে।

ইবনু আব্বাস রা. তাকওয়া অর্জনকারি মুত্তাকির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন: “মুত্তাকি তারা, যারা আল্লাহ ও তার শাস্তিকে ভয় করে।”

তালক ইবনু হাবিব বলেছেন: “তাকওয়ার অর্থ: আল্লাহর নির্দেশমতো তুমি তার আনুগত্য কর ও তার সাওয়াবের আশা রাখ এবং তার নির্দেশমতো তার নাফরমানি ত্যাগ কর ও তার শাস্তিকে ভয় কর।”

তাকওয়ার উপকারিতা

১. তাকওয়া মানুষকে শয়তানের ফাঁদ থেকে রক্ষা করে

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَوۡاْ إِذَا مَسَّهُمۡ طَٰٓئِفٞ مِّنَ ٱلشَّيۡطَٰنِ تَذَكَّرُواْ فَإِذَا هُم مُّبۡصِرُونَ ٢٠١ ﴾ [الاعراف: ٢٠٠]

“নিশ্চয় যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে যখন তাদেরকে শয়তানের পক্ষ থেকে কোন কুমন্ত্রণা স্পর্শ করে তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। তখনই তাদের দৃষ্টি খুলে যায়।” [সুরা আরাফ: (২০১)]

২. তাকওয়া রিজিক ও বরকত বৃদ্ধি করে

﴿ وَلَوۡ أَنَّ أَهۡلَ ٱلۡقُرَىٰٓ ءَامَنُواْ وَٱتَّقَوۡاْ لَفَتَحۡنَا عَلَيۡهِم بَرَكَٰتٖ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ ٩٦ ﴾ [الاعراف: ٩٥]

“আর যদি জনপদসমূহের অধিবাসীরা ইমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তাহলে আমি অবশ্যই আসমান ও জমিন ‎‎থেকে বরকতসমূহ তাদের উপর খুলে দিতাম।” [সুরা আরাফ: (৯৬)]

৩. কল্পনাতীত জায়গা থেকে রিজিক লাভ করে তাকওয়াবান ব্যক্তি

﴿ وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّهُۥ مَخۡرَجٗا ٢ وَيَرۡزُقۡهُ مِنۡ حَيۡثُ لَا يَحۡتَسِبُۚ ٣ ﴾ [الطلاق: ٢، ٣]

“যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না।” [সুরা তালাক: (২-৩)]

৪. তাকওয়া অবলম্বনের কারণে বান্দা বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি পায় 

﴿ وَتَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡبِرِّ وَٱلتَّقۡوَىٰۖ وَلَا تَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِۚ ٢ ﴾ [المائدة: ٢]

“সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।” [সুরা মায়েদা: (২)]

وقال تعالى في قصة مريم: ﴿ فَأَرۡسَلۡنَآ إِلَيۡهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرٗا سَوِيّٗا ١٧ قَالَتۡ إِنِّيٓ أَعُوذُ بِٱلرَّحۡمَٰنِ مِنكَ إِن كُنتَ تَقِيّٗا ١٨ ﴾ [مريم: ١٧، ١٨]

মারইয়াম আলাইহিস সালামের ঘটনায় আল্লাহ তাআলা বলেন: “তখন আমি তার নিকট আমার রূহ (জিবরীল)কে প্রেরণ করলাম। অতঃপর সে তার সামনে পূর্ণ মানবের রূপ ধারণ করল। মারইয়াম বলল, ‘আমি তোমার থেকে পরম করুণাময়ের আশ্রয় চাচ্ছি, যদি তুমি মুত্তাকি হও।” [সুরা মারইয়াম: (১৭-১৮)]

৫. আমলে শুদ্ধতা লাভের উপায় তাকওয়া অবলম্বন

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَقُولُواْ قَوۡلٗا سَدِيدٗا ٧٠ يُصۡلِحۡ لَكُمۡ أَعۡمَٰلَكُمۡ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۗ ٧١ ﴾ [الأحزاب: ٧٠، ٧١]

“হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজগুলোকে শুদ্ধ করে দেবেন এবং তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই এক মহা সাফল্য অর্জন করল।” [সুরা আহজাব: (৭০-৭১)]

৬. হিদায়াতের পথে থাকার উপায় তাকওয়া অবলম্বন করা

﴿ وَأَنَّ هَٰذَا صِرَٰطِي مُسۡتَقِيمٗا فَٱتَّبِعُوهُۖ وَلَا تَتَّبِعُواْ ٱلسُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمۡ عَن سَبِيلِهِۦۚ ذَٰلِكُمۡ وَصَّىٰكُم بِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٥٣ ﴾ [الانعام: ١٥٣]

“আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা ‎‎তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।” [সুরা আনআম: (১৫৩)]

৭. তাকওয়ার দ্বারা আল্লাহর রহমত পাওয়া যায়

﴿وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡءٖۚ فَسَأَكۡتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱلَّذِينَ هُم بَِٔايَٰتِنَا يُؤۡمِنُونَ ١٥٦ ﴾ [الاعراف: ١٥٥]

“আর আমার রহমত সব বস্তুকে পরিব্যাপ্ত করেছে। সুতরাং আমি তা লিখে দেব তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং জাকাত প্রদান করে। আর যারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি ইমান আনে।” [সুরা আরাফ: (১৫৬)]

৮. তাকওয়ার দ্বারা পরিণাম উত্তম হয়

﴿ وَٱلۡعَٰقِبَةُ لِلتَّقۡوَىٰ ١٣٢ ﴾ [طه: ١٣٢]

“আর শুভ পরিণাম তো মুত্তাকিদের জন্য।” [সুরা ত্বহা: (১৩২)]

وقال تعالى: ﴿ وَإِنَّ لِلۡمُتَّقِينَ لَحُسۡنَ مََٔابٖ ٤٩ ﴾ [ص: ٤٩]

তিনি অন্যত্র বলেন: “আর মুত্তাকীদের জন্য অবশ্যই রয়েছে উত্তম নিবাস।” [সুরা সাদ: (৪৯)]

وقال تعالى: ﴿ إِنَّ ٱلۡعَٰقِبَةَ لِلۡمُتَّقِينَ ٤٩ ﴾ [هود: ٤٩]

তিনি আরো বলেন: “নিশ্চয় শুভ পরিণাম কেবল মুত্তাকিদের জন্য।” [সুরা হুদ: (৪৯)]

৯. তাকওয়া অবলম্বনের দ্বারা কাজ সহজ হয়ে যায়

﴿ وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّهُۥ مِنۡ أَمۡرِهِۦ يُسۡرٗا ٤ ﴾ [الطلاق: ٤]

“যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।” [সূরা তালাক: (৪)]

وقال تعالى: ﴿ فَأَمَّا مَنۡ أَعۡطَىٰ وَٱتَّقَىٰ ٥ وَصَدَّقَ بِٱلۡحُسۡنَىٰ ٦ فَسَنُيَسِّرُهُۥ لِلۡيُسۡرَىٰ ٧ ﴾ [الليل: ٥، ٧]

তিনি আরো বলেন: “সুতরাং ‎‎যে দান করেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে, আর উত্তমকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছে, আমি তার জন্য সহজ পথে চলা সুগম করে দেব।” [সুরা লাইল: (৫-৭)]

 

তাকওয়া মুমিনদের হৃদয়ে পথপ্রদর্শক আলোর মতো কাজ করে। এটি মুমিনদেরকে তাদের উদ্দেশ্য স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আল্লাহর গভীর চেতনাকে অন্তরে লালন করতে সাহায্য করে। তাকওয়া গড়ে তোলার মাধ্যমে বান্দার আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি হয়, পাপের পরিণতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং চিরন্তন পুরস্কার অর্থাৎ জান্নাত লাভের পথ খুলে দেয়। আসুন আমরা তাকওয়াকে আলিঙ্গন করার চেষ্টা করি, আল্লাহর নৈকট্য কামনা করি এবং এর দীপ্তিকে আমাদের জীবনকে আলোকিত করার সুযোগ করে দেই। [৬]

 

পাদটীকা: 

[১] উইকিপিডিয়া অবদানকারী। “তাকওয়া।” উইকিপিডিয়া, একটি মুক্ত বিশ্বকোষ। উইকিপিডিয়া, একটি মুক্ত বিশ্বকোষ, ১৩ নভে। ২০২২। ওয়েব। ১৮ মে. ২০২৩।

[২] সহিহ মুসলিম

[৩] সুনানু তিরমিজি

[৪] সহিহ মুসলিম: ৬২৮৫

[৫] বায়হাকি

[৬] https://islamhouse.com/read/bn/%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BE-371391.

Leave a Comment