এখনো ক্লাসে সবাই ফেরেনি

এখনো ক্লাসে সবাই ফেরেনি

করোনার আগে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ। এখন তা ৬০ শতাংশে সীমাবদ্ধ।

আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে শ্রেণিকক্ষে ফিরেছে সহপাঠীরা। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে চলছে তাদের গল্প-আড্ডা ও খেলা। তবে এই খুশি স্পর্শ করেনি জান্নাতুল ফেরদৌসকে। সবাই যখন ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত, তখন সে বসে আছে গ্রামে। চিরচেনা স্কুলে কবে ফিরবে, সেটি তার জানা নেই।

নাসিরাবাদ কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস। করোনা মহামারিতে চাকরি হারিয়েছিলেন বাবা ওসমান গণি। এরপরও কিছুদিন ছিলেন শহরে। শেষ পর্যন্ত আর টিকতে পারেননি। গত এপ্রিলে স্ত্রী তাসলিমা বেগম ও মেয়েকে নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। এখনো সেখানে আছেন।

জান্নাতুল ফেরদৌসের মা তাসলিমা বেগম মুঠোফোনে বলেন, অর্থসংকটের কারণে কর্ণফুলীর চরলক্ষ্যা গ্রামে চলে এসেছেন তাঁরা। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে আর শহরে যাওয়া সম্ভব নয়। মেয়েকে এখানকার কোনো স্কুলে ভর্তি করানোর চিন্তা আছে। কিন্তু হঠাৎ সবকিছু পরিবর্তন হওয়ার প্রভাব পড়েছে মেয়ের মনে। মেয়ে পড়ালেখায় ভালো ছিল। এখন মনোযোগ কমে গেছে।

করোনা মহামারির কারণে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খুলেছে। কিন্তু জান্নাতুলের মতো অনেক শিক্ষার্থী এখনো শ্রেণিকক্ষে ফিরতে পারেনি। তাদের অনেকেই পরিবারের সঙ্গে গ্রামে চলে গেছে। কেউ কেউ যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন কাজে। ফলে শ্রেণি কার্যক্রম চললেও উপস্থিতি তুলনামূলক কম।

গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম শহরের পূর্ব নাসিরাবাদ এ জলিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লালখান বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং নাসিরাবাদ কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির এই চিত্র পাওয়া গেছে।

বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকেরা জানান, যখন করোনা ছিল না, তখন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ। তবে এখন তা ৬০ শতাংশে সীমাবদ্ধ।

চট্টগ্রাম শহরের সিঅ্যান্ডবি কলোনি এলাকায় অবস্থিত নাসিরাবাদ কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গতকাল সকালে গিয়ে দেখা যায়, শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিচ্ছিলেন শিক্ষকেরা। প্রতিটি বেঞ্চে একজন করে শিক্ষার্থী। কিছু কিছু আসন ফাঁকা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সবার মুখে মাস্ক। ছাত্রছাত্রীদের ভিড় কম।

গতকাল প্রথম শ্রেণিতে ১৪৩ জনের মধ্যে ৪৫ জন, পঞ্চম শ্রেণিতে ২১১ জনের মধ্যে ৮০ জন এবং অষ্টম শ্রেণির ৮৬ শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিল ৭৪ জন। ১২ সেপ্টেম্বর খোলার প্রথম দিন পঞ্চম শ্রেণির ২১১ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১১৮ এবং তৃতীয় শ্রেণির ১৪২ জনের মধ্যে ৮৭ জন উপস্থিত ছিল।

ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার কম হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফারহানা নাজনীন বলেন, অনেক দিন পর বিদ্যালয় খুলেছে। অনেকেই করোনার কারণে এই মুহূর্তে বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে আনার ব্যাপারে আগ্রহী নন। তবে করোনার কারণে অনেকের মা-বাবার চাকরি চলে গেছে। অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে শহরে থাকার খরচ সামলাতে না পেরে অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন। তাঁদের সন্তানেরা বিদ্যালয়ে আসছে না। কম উপস্থিতির এটি একটা বড় কারণ।

নগরের ২ নম্বর গেটে অবস্থিত পূর্ব নাসিরাবাদ এ জলিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গতকাল পঞ্চম শ্রেণিতে ১৩৯ শিক্ষার্থীর ১১২ জন উপস্থিত ছিল। তবে প্রথম শ্রেণির ৭১ জনের মধ্যে স্কুলে আসেনি ৩৪ জন।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, আগের দিন স্কুল বন্ধ ছিল। আর ঝড়বৃষ্টি হয়েছে কয়েক দিন ধরে। এ জন্য আপাতত উপস্থিতি কম।
নগরের লালখান বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের আশপাশে নিম্ন আয়ের লোকজনের বসতি বেশি। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ আসে এসব পরিবার থেকে। গতকাল বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে উপস্থিতির হার ছিল ৭১ শতাংশ। আর প্রথম শ্রেণিতে ৬২ শতাংশ। এটিই বিদ্যালয়ের উপস্থিতির নিয়মিত চিত্র।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আজাদ ইকবাল পারভেজ বলেন, করোনার কারণে আয়রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই শহর ছেড়ে চলে গেছেন। আবার নিম্ন আয়ের লোকজন তাঁদের সন্তানদের বিভিন্ন কাজে যুক্ত করে দিয়েছেন। এসব কারণে উপস্থিতি কম হচ্ছে।

চট্টগ্রাম শহরে ২১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় দুই লাখ ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত। বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। তবে ছয়টি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী রয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, এখন শহরের তুলনায় গ্রামের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে বেশি। কী কারণে কম উপস্থিতি, তার স্পষ্ট কারণ আগামী সপ্তাহে বোঝা যাবে। আপাতত করোনায় অভিভাবকদের গ্রামে চলে যাওয়ার কারণে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি কম মনে হচ্ছে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *