একটি গল্প এবং কিছু শিক্ষা

ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তাসনিম। জাহেলি জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধির পর থেকে নিজেকে সার্বিকভাবে দ্বীনের পথে পরিচালিত করতে থাকে সে। প্রথমে সেক্যুলার ফ্রেন্ড সার্কেল থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়া, তারপর নামাজ কালাম এর প্রতি নিয়মিত হওয়া, ধীরে ধীরে নিজেকে পর্দায় আবৃত করে নেয়া এভাবেই ভার্সিটি লাইফে একাডেমিক এবং এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসে সবচেয়ে নিয়মিত ছাত্রীটি হয়ে পড়ে ধীরে ধীরে অনিয়মিত!

সে উপলব্ধি করতে সমর্থ হয় এই সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা তাকে ঝকঝকে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়ার হাতছানি দিলেও, ধীরে ধীরে কেড়ে নিয়েছে লজ্জা, হায়া, নারীত্ব এবং সর্বোপরি ঈমান!

তাই ভার্সিটি জীবনকে মাঝপথেই বিদায় জানিয়ে অবশেষে দ্বীনের পথে সিরিয়াসলি চলতে শুরু করে তাসনিম। তার উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার প্রথমে তার সিদ্ধান্ত কে পাগলামি, ঔদ্ধত্য, বোকামি বললেও তার জেদের কাছে অবশেষে হার মেনে যায়।

এদিকে দিন গড়ায়, তাসনিম নিজেকে আল্লাহমুখী করার চেষ্টায় এগিয়ে যেতে থাকে অন্যদিকে জীবনের প্রয়োজনে একজন দ্বীনদার সাথীর জন্য তার মন প্রায়ই কেঁদে উঠে। অবশেষে এক দ্বীনদার ছেলের সাথে তার বিয়ের কথা ফাইনাল হয়ে যায়। তাসনিম আর রিদওয়ান একে অপরের দ্বীনদারিতায় মুগ্ধ হয়ে অবশেষে জান্নাত পর্যন্ত সাথী হবার পথে এগিয়ে যায় বিয়ের মাধ্যমে।

বিয়ের পর মধুর সময় কাটতে থাকে একে অপরের সাথে। দিন গড়িয়ে মাস যায়, এভাবে বছর দুয়েক কেটে যায়। দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক ব্যস্ততায় জীবন হয়ে উঠে গতানুগতিক। রিদওয়ান তার অফিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, অন্যদিকে তাসনিম বাসায় শ্বাশুড়ির সাথে ঘরের কাজকর্মে থাকে টুকটাক ব্যস্ত।

এরই মধ্যে তাসনিম এর সোশ্যাল মিডিয়ায় একে একে পরিচয় হয়েছে কিছু দ্বীনদার বোনদের সাথে। তাদের ইন্টালেকচুয়াল পোস্ট দেখে সে প্রায়ই প্রভাবিত হয়। একেকজন আই বি এ, দেশসেরা পাব্লিক ভার্সিটি, এমনকি বাইরে থেকে পি এইচ ডি করে আসা দ্বীনি বোনদের কথায় প্রভাবিত না হয়ে আর উপায় কি!

ইদানীং তার দ্বীনি বোনরা একেক জন হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তা। এত একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন থাকা সত্বেও কেবল ঘরে বসে থাকা, বাচ্চা সামলানোতে নিজেদের একাডেমিক যোগ্যতার অপমান হয়। তারা এখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন সফল নারী উদ্যোক্তা হয়ে দ্বীনি বোনদের হীনমন্যতা কে পরিবর্তন করার নিমিত্তে।

কেউ শো রুম দিচ্ছেন, কেউ বা পর্দা করেও হয়ে উঠছেন পত্রিকার শিরোনাম, বিভিন্ন ফেয়ারে অংশ নেয়া, বাচ্চা স্বামীর গন্ডিতে বন্দী না থেকে বাইরের জগতেও তারা রাখছেন বিশেষ সাফল্য। পর্দা করলেই কি ঘরে বসে থাকতে হবে? কেবল কি স্বামীর ইনকামে সন্তুষ্ট থাকতে হবে? একটু হাই ক্লাস লাইফস্টাইল মেইন্টেইন করতে গেলে স্বামীর ইনকাম যেনো যথেষ্ট নয়।

এভাবেই তথাকথিত দ্বীনি বোনদের লেখা, পোস্ট, ছবি, পেজ, শো রুম, সফলতার গল্পগুলো তাসনিম কে প্রভাবিত করতে থাকে গভীরভাবে। সেও ভাবতে শুরু করে তার যোগ্যতার বিপরীতে কেবল সংসার করে যাওয়া তার মেধার অপচয়। তাকেও নারী উদ্যোক্তা হতে হবে, তার ও আইডেন্টিটি থাকতে হবে। বোনদের পর্দার পেজে কালারফুল সব বোরকার সমাহার আর তাদের রংচঙে ছবি দেখে সেও নিজের হীনমন্যতা ছেড়ে আধুনিক হতে চায়। মুখ তো খোলা রাখাই যায়, এমন কালো কুচকুচে ঢিলেঢালা বোরকা না পড়ে একটু স্টাইলিশ কালারফুল বোরকা, হিজাব পড়াই যায়।

এভাবেই তাসনিম এর মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। সে তার পর্দার কাপড়ে পরিবর্তন আনা শুরু করে, কালো খ্যাতমার্কা বোরকা ছেড়ে কালারফুল স্টাইলিশ বোরকা পড়তে শুরু করে। প্রায়ই দ্বীনি বোনদের ফেয়ারে অংশ নেয়, তাদের মত উদ্যোক্তা হবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সেও ব্যবসায় নেমে পড়ে। এদিকে রিদওয়ান তার পরিবর্তন দেখে মেনে নিতে পারেনা। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও সে বুঝতে রাজি না। ইদানীং ঘরের চেয়ে ঘরের বাইরেই সে বেশি সময় কাটাতে শুরু করে। পর্দা করেও ব্যবসা করা যায়, এই ব্রত নিয়েই সেও তার মডার্ণ দ্বীনি সিস্টারদের মত সফলতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠে।

এদিকে রিদওয়ান শত বুঝিয়েও তাকে এই ট্র‍্যাপ থেকে বের করতে পারেনা। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে, এক সময় তাসনিম তার উপার্জনের কারণে সুপেরিয়রিটি কম্পলেক্সে ভুগতে থাকে। রিদওয়ান এর ইনকাম দিয়ে যেনো সংসার আর চলেই না। কথায় কথায় তার নিজের আর্নিং এর বড়ত্ব দেখাতে গিয়ে রিদওয়ান কে ছোট করে কথা বলা শুরু করে। এক সময় ঝগড়া শেষ পর্যন্ত তালাকে গিয়ে শেষ হয়।

গল্পটা যদিও যেমন তেমন, কিন্তু বর্তমানে দ্বীনি সিস্টারদের মহলে এমন মডারেট আর ফেমিনিস্টদের প্রভাব বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে তথাকথিত কিছু সেলিব্রেটিদের প্রভাবে সহজ সরল দ্বীন মানতে চাওয়া বোনেরা ঘর ছেড়ে ঘরের বাইরে পর্দা করেও সব করা যায় প্রবণতার দিকে ঝুকে পড়ছে এইসব তথাকথিত মডারেট আর ফেমিনিস্টদের পাল্লায় পড়ে!

ইসলাম যেখানে নারীদের বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত বাইরে যাবার পক্ষপাতি নয়, সেখানে তারা পর্দার আড়ালে, নিজেদের যোগ্যতার প্রতি সুবিচার এর নাম করে দ্বীনি বোনদেরকে সংসার বিমুখ করছে এইসব বিষাক্ত নারীরা। তারা তাদের তথাকথিত ইন্টালেকচুয়াল সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্সের যাদুতে আক্রান্ত করে চলছে অনেক ইখলাস সম্পন্ন দ্বীনী বোনদের।

এভাবেই সেক্যুলার লাইফ ছেড়েও সেই একই আদর্শে মনের অজান্তেই জড়িয়ে যাচ্ছে কত বোনেরা। ইসলাম যেখানে নারীদেরকে ঘরে থাকার প্রতি, স্বামী সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে সম্মানের দিকে ডাকে, সেই নববী আদর্শের বিপরীতে এইসব দ্বীনি ফেমিনিস্ট আর মডারেটরা এক ধরণের আল্ট্রা এলিট ক্লাস সেক্যুলার মনোভাবাপন্ন লাইফস্টাইলের দিকে ডাকছে, যা অনেক বোনেরা বুঝতেও পারছেন না।

তাই আপনার সার্কেলে দ্বীনদার বোন নামে কারা আসলে যুক্ত আছে সেদিকে নজর দিন, তারা কি আদৌ তাদের লেখা, কথা কাজে ইসলামের আদর্শ কে ধারণ করছে নাকি মডারেট হয়ে ফেমিনিজম এর বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে আপনার অজান্তে সেদিকে খেয়াল করুন।

আপনি যদি পুরুষ হয়ে থাকেন, তবে আপনার স্ত্রীর দ্বীনি সিস্টার সার্কেলের ব্যাপারে খোঁজ নিন, সে কাদের পোস্ট পড়ে, শেয়ার করে, তাদের মাঝে মডারেট ফিতনা আছে কিনা, ফেমিনিজমের বিষ আছে কিনা অবশ্যই সেই ব্যাপারে নজর দিন। এইসব ফিতনার ব্যাপারে তাকে সচেতন করুন এবং কম্পেরেটিভলি ইসলামের আদর্শ তুলে ধরুন।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে অনেক বিখ্যাত, পরিচিত সেলিব্রেটি  পেজ আর আইডি থেকে এইসব ছড়ানো হয়, হচ্ছে যেই ব্যাপারে অনেকের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই! আল্লাহ হিফাযত করুন, হিদায়াত দিন, আমাদের সচেতন হবার তৌফিক দিন।

– মাহফুজ আল আমিন

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *