মুক্তিপণের জন্য চার স্কুলছাত্রকে অপহরণ করে টেকনাফের পাহাড়ি আস্তানায় রেখেছিল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একটি দল। হাত-পা বেঁধে টানা পাঁচ দিন চলেছে বেধড়ক পিটুনি। ওই সন্ত্রাসী দলের সবার হাতে ছিল রাইফেল ও পিস্তল। অস্ত্রধারীরা সবাই রোহিঙ্গা ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেছে। অস্ত্রধারীরা নিজেরা দৈনিক তিন বেলা খাবার খেলেও স্কুলছাত্রদের এক বেলা খাবার দেওয়া হতো।অপহরণের শিকার হওয়া দুই ছাত্র মো. কায়সার (১৫) ও মিজানুর রহমান (১৪) আজ শনিবার দুপুরে র্যাব-১৫ কক্সবাজার কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানায়।
আজ সকাল ছয়টার দিকে টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিবের পশ্চিম পাশের পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে মিজানুর রহমানকে র্যাব উদ্ধার করে।এর আগে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের পাশের পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে অপহরণের শিকার স্কুলছাত্র মো. কায়সারকে উদ্ধার করে র্যাব। আর জাহিদুল ইসলাম (১৪) ও মিজানুর রহমান নয়নকে (১৪) উদ্ধার করেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা। অপহরণের শিকার চার স্কুলছাত্রের বাড়ি রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের প্যাঁচার দ্বীপের মংলা পাড়ায়।আস্তানায় হাত-পা বেঁধে তাদের প্রতিদিন মারধর করা হতো। তাদের ঠিকমতো খেতেও দেওয়া হতো না। অপহরণকারীরা তিন বেলা খাবার খেলেও তাদের শুধু দুপুরের খাবার দেওয়া হতো। সেখানেও ভাত আর আলুভর্তা ছাড়া আর কিছুই মিলত না।
টানা পাঁচ দিন পাহাড়ের আস্তানায় দুর্বিষহ জীবন কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছে মিজানুর। অপহরণ কীভাবে হয়েছিল জানতে চাইলে মিজানুর জানায়, তার বাড়ির পাশেই বাতিঘর নামে একটি রিসোর্ট আছে। ওই রিসোর্টে রোহিঙ্গা তরুণ ইব্রাহিম ও জাহাঙ্গীর চাকরি করতেন। সেই সুবাদে ইব্রাহিম ও জাহাঙ্গীরের সঙ্গে মিজানুর ও তার বন্ধুদের সখ্য গড়ে ওঠে। কিছুদিন ধরে ইব্রাহিম মিজানুর ও তার বন্ধুদের নিয়ে সেন্ট মার্টিন বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে আসছিলেন। ৭ ডিসেম্বর ইব্রাহিম ও জাহাঙ্গীর চার ছাত্রকে নিয়ে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে টেকনাফ থেকে রওনা দেন। মাঝপথে তাঁরা টেকনাফের হ্নীলার একটি হোটেলে গিয়ে নাশতা করেন। পরে ইব্রাহিম চার ছাত্রকে পাহাড়ের কাছে একটি পরিত্যক্ত নার্সারিতে নিয়ে যান। নার্সারিতে কিছুক্ষণ থাকার পর তাঁরা রাতে আবার হ্নীলার ওই হোটেলে ফিরে যান। পরের দিন (৮ ডিসেম্বর) বিকেলে চার ছাত্রকে নিয়ে পাহাড়ের কাছে একটি পেয়ারা বাগানে নিয়ে যান ইব্রাহিম। সেখানে ইব্রাহিমের সঙ্গে রানা নামে আরেক তরুণ যুক্ত হন।
মিজানুর বলে, পেয়ারা বাগানে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সেখানে কয়েকজন লোক এসে ইব্রাহিম ও রানার সঙ্গে কথা বলে চলে যান। এরপর ইব্রাহিম মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার কথা বলেন। তখন বিকেল চারটা। কিছুক্ষণ পর পাঁচ-ছয়জন লোক পেয়ারা বাগানে এসে অস্ত্র ধরে তাদের চারজনকে জিম্মি করে পাহাড়ের ভেতরে নিয়ে যান। পাহাড়ের আস্তানায় অস্ত্রধারী ১০ জন সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন। অস্ত্রধারীরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় সবার পরিচয় জেনে নেন। এরপর ইব্রাহিম ও রানাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর মিজানুর ও তার বন্ধুদের হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। তারপর লাঠি দিয়ে তাদের বেধড়ক মারধর করা হয়।৮ ডিসেম্বর তাঁর ছেলে ফোনে জানায়, পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করতে না পারলে তাকে মেরে ফেলবে। ‘এত টাকা কোথায় পাব’—এটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই অস্ত্রধারীরা তাঁর ছেলেকে মারধর শুরু করে। ফোনের ওপাশ থেকে তিনি ছেলেকে মারধরের শব্দ এবং চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন।
জখম হওয়া হাত-পা দেখিয়ে মিজানুর রহমান বলে, ‘টানা পাঁচ দিন পাহাড়ের আস্তানায় থেকে অনেক অভিজ্ঞতা হলো। রোহিঙ্গা ওই সন্ত্রসীদের হাতে ভারী অস্ত্রশস্ত্র। পাহাড়ের ভেতর রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি আস্তানা আছে। পুলিশের হাতে যেন ধরা না পড়ে, তাই আমাদের বিভিন্ন আস্তানায় স্থানান্তর করা হয়েছিল।’উদ্ধার আরেক স্কুলছাত্র মো. কায়সার জানায়, মুঠোফোনে খবর এলে তাদের এক আস্তানা থেকে অন্য আস্তানায় নিয়ে যেত। প্রতিটি আস্তানাতেই ১০-১৫ জন করে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী থাকতেন। ৯ ডিসেম্বর রাতে তাদের পরপর তিনটি আস্তানায় স্থানান্তর করা হয়েছিল।কায়সার বলে, আস্তানায় হাত-পা বেঁধে তাদের প্রতিদিন মারধর করা হতো। তাদের ঠিকমতো খেতেও দেওয়া হতো না। অপহরণকারীরা তিন বেলা খাবার খেলেও তাদের শুধু দুপুরের খাবার দেওয়া হতো। সেখানেও ভাত আর আলুভর্তা ছাড়া আর কিছুই মিলত না।
মিজানুর রহমানের বাবা মো. আলম বলেন, ‘পাঁচ দিন ধরে ছেলে নিখোঁজ ছিল। জীবন নিয়ে ফিরে আসার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আল্লাহ রহম করেছে, ছেলেকে ফিরে পেয়েছি।’মো. কায়সারের বাবা আবদুর রহিম বলেন, ৮ ডিসেম্বর তাঁর ছেলে ফোনে জানায়, পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করতে না পারলে তাকে মেরে ফেলবে। ‘এত টাকা কোথায় পাব’—এটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই অস্ত্রধারীরা তাঁর ছেলেকে মারধর শুরু করে। ফোনের ওপাশ থেকে তিনি ছেলেকে মারধরের শব্দ এবং চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু মুক্তিপণ দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার উপায় ছিল না তাঁর।পুলিশ জানায়, ইতিমধ্যে জাহাঙ্গীর, সাদ্দাম মিয়াসহ অপহরণ চক্রের পাঁচ রোহিঙ্গাকে র্যাব ও এপিবিএন আটক করেছে। এর মধ্যে আজ সকালে জাহাঙ্গীর ও জাভেদ নামের দুই রোহিঙ্গা তরুণকে আটক করেছে র্যাব। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে টেকনাফের মুচনী ক্যাম্পের বাসিন্দা নুর সালাম, তাঁর মেয়ে রনজন বিবি ও আরেক রোহিঙ্গা সাদ্দাম মিয়াকে এপিবিএন আটক করে। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চার স্কুলছাত্রকে পাহাড় থেকে উদ্ধার করা হয়।
র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খাইরুল ইসলাম বলেন, চার স্কুলছাত্রকে উদ্ধারের পাশাপাশি অপহরণ চক্রের সদস্যদের ধরার চেষ্টা চলছে।প্রসঙ্গত, ৭ ডিসেম্বর সকালে সেন্ট মার্টিন বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা উখিয়ার সোনারপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীকে অপহরণ করেন। এরপর ৮ ডিসেম্বর রাতে অপহৃত শিক্ষার্থীদের স্বজনদের কাছে ফোন করে চার শিক্ষার্থীর মুক্তিপণ হিসেবে ৫ লাখ টাকা করে মোট ২০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। মুক্তিপণ না দিলে শিক্ষার্থীদের হত্যা করে লাশ গুম করা হবে বলেও হুমকি দিয়েছিলেন অপহরণকারীরা।